–প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
রাজধানী ঢাকায় ঘন ঘন প্রলয়ঙ্কারী অগ্নিকান্ডের ঘটনার সাথে নিরীহ মানুষের পুড়ে অঙ্গার হয়ে মারা যাবার ঘটনাগুলো অত্যন্ত বেদনাদায়ক। যারা অগ্নিকান্ডের শিকার হয়ে কোনরকমে বেঁচে গিয়ে অঙ্গহানি হয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরিয়ে জীবন অতিবাহিত করে চলেছেন সেগুলো আরো বেশী হৃদয়বিদারক। কারণ, তাদের পঙ্গু জীবন নিজের ও পরিবারের নিকট কতটা কষ্টের বিষয় সেটা শুধু ভুক্তভোগি পরিবারগুলোই উপলব্ধি করতে পারবেন। এসব কষ্টকর ঘটনা সংবাদ হয়ে সমাজ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিরাট নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিচ্ছে।
প্রতিবছর রাজধানী ঢাকায় যখন-তখন, যেখানে-সেখানে বড় বড় অগ্নিকান্ড ঘটার ঘটনা যেন একটি নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানী ঢাকার প্রাকৃতিক বায়ুর গুণমান এতটাই নিম্ন থাকে যে প্রতিদিন সংবাদের শিরোনাম হয়ে সারা পৃথিবীর মানুষের নিকট এটি বসবাসের নিকৃষ্টতম স্থান হিসেবে সংবাদমাধ্যমে দ্রুত প্রকাশিত হয়ে পড়ে। আমরা সেসব সংবাদে চোখ বুলাই আর চোখ বুঁজে সহ্য করে যাই।
কিন্তু ক’বছর ধরে বিভিন্ন কারখানা, গুদাম ও বহুতল আবাসিক ভবনে অগ্নিকান্ডের ফলে মর্মান্তিক মৃত্যুগুলো চোখ বুঁজে সহ্য করার শক্তিও হারিয়ে দিচ্ছে। তার সাথে এবার যুক্ত হয়ে গেল খাবারের রেঁস্তোরার টেবিলে খাবার সামনে নিয়ে হঠাৎ মৃত্যুর হীমশীতল ডাকের সাড়া দেবার মর্মন্তুদ ঘটনা। যেটি দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিষাদের ছায়া ফেলে দিয়েছে।
বেইলী রোডের কোজি ভবনের নিচতলার চায়ের দোকান থেকে সামান্য আগুণের সূত্রপাত কেন এত বড় হলো? কেন এমন ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরী হলো? রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দুতে আধুনিক অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা সচল থাকার পরও কেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে এতগুলো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিল? এসব আগুনের মৃত্যুগ্রাস কেন বার বার ভয়ংকর দাঁত বের করে এগিয়ে আসে? এমন প্রশ্নের কারণ বহুমুখী। এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া খুব সহজ। কিন্তু সেসব উত্তরের গভীরতা উপলব্ধি করার মতো পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে রহস্যের কমতি নেই!
ঢাকার আধিবাসীরা প্রায়শ: বাইরের পৃথিবীতে ঘুরতে যান, কেনাকাটা, শিক্ষা, চিকিৎসা, ভ্রমণ করে ফিরে আসেন। ফিরে এসে শুধু গাল-গল্প করেন। আর পুনরায় কুটরির মধ্যে বসতি গেঁড়ে কোনরকমে থাকতে ভালবাসেন। এক ইঞ্চি জায়গাও ফাঁকা না রেখে বহুতল বাড়ি তৈরী করেন। আবাসিকতার নামে ঢাকায় গড়ে উঠেছে ইট-পাথরের স্তুপ। একজনের আটতলা বাড়ির জানালা খুললে পাশের ভবনের দশতলার জানালা দিয়ে সবকিছুই দেখা যায়। বাতাস খেলা করে না সেসব বাসায়। সুউচ্চ ভবন হলেও সূর্যের আলো ঢোকার সুযোগ নেই। দৃষ্টিহরণকারী রঙ্গীন বা কালো কাঁচ অথবা ভারী পর্দা দিয়ে পরস্পরের জানালা আড়াল করে রাখা হয়।
আর একটি বিশেষ দিক চালু হয়েছে কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। এটাকে বিদ্দুৎ সাশ্রয়ী করার জন্য কক্ষের উচ্চতা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। শোলা, কাগজ, তুলো, রেক্সিনের আবরণ ইত্যাদি দিয়ে তৈরী করা হয়েছে বাহারী এন্টিরিওর ডিজাইন। সুপার মার্কেট, অফিস, এমনকি হাসপাতাল সবজায়গায় মোটা কাঁচের কুটরি তৈর্য করে প্রাকৃতিক আলো বাতাস বন্ধ করে ট্রাপ বা ফাঁদ তৈরী করা হয়েছে।
অত্যাধুনিক ডেকোরেশনের নামে অভিজাত খাবারের দোকানগুলো সবচেয়ে বেশী এগিয়ে। জানালা বন্ধ রেখে এন্টিরিওর ডিজাইন করার ফলে বিদ্দুৎ চলে গেলে এমনকি জেনারেটরের তেল ফুরিয়ে গেলে গ্রাহকদেক গরমে হাঁসফাস করতে করতে খাবার খেতে হয়।
এই প্রবণতা শুধু ঢাকায় নয়- দেশের সব শহরেই শুরু হয়েছে। এখন এটাই আধুনিক ফ্যশন। শীতপ্রধান দেশের আবরণ ও আভরণে বাংলাদেশের মতো গরমের দেশে এসব প্রযুক্তি ও ফ্যাশন কিছুটা জৌলুষ ছড়ালেও নিরাপত্তার কথাটি কেউই মাথায় রাখেননি। তাই ঢাকায় আলোর ঝলকানির আড়ালে নিরাপত্তাহীনতার চাদরের মধ্যে বসে অপেক্ষা করছে মৃত্যুদূতেরা। বেইলী রোডের কোজি ভবনে সাততলার প্রতিটিতে খাবারের দোকান ছিল। সেখানে এত স্বল্প স্থানে বারটি রেঁস্তোরার কথা জানা গেছে। এর আশেপাশের ভবনগুলোর শুধু একটিতেই ২০ রেস্তোঁরা রয়েছে! বুঁফে খাবারের ব্যবস্থাও আছে। এজন্য শতাধিক পদ রান্নায় শতাধিক অগ্নিবোমা সদৃশ সিলিন্ডারে চুলা জ্বালানো হয়, খাবার টেবিলে জ্বলন্ত চুলায় কিছু মেন্যু সার্ভ করা হয়।
কথা হলো- সেখানে এত বেশী খরিদ্দারের আনাগোনা হয় যে তা বলাই বাহুল্য। সেসব খরিদ্দারের ৫০ ভাগও যদি গাড়ি নিয়ে খেতে আসেন তাহলে সেসব গাড়ির পার্কিং করা হয় কোথায়? কিছু ভবনের বেসমেন্টে কয়েকটি করে গাড়ি পার্কিং-এর ব্যবস্থা আছে। বাকিদের নেই। তারা নিশ্চয়ই রাস্তার মধ্যে গাড়ি রাখেন। আর সেজন্য বেইলী রোডে সবসময় যানবাহনের জটলা লেগে থাকে।
বাইরের বিশ্বে সুপার মার্কেট ও অভিজাত খাবারের দোকানগুলো শহর থেকে অনেক দূরে খোলামেলা জায়গায় বানানোর অনুমতি দেয়া হয়। বাংলাদেশে ঘরের সাথে বাজার ও ঘরের পাশে রেঁস্তোরা না হলে চলবে কি করে? ঘরকুনো বাঙালী বিদেশে গিয়ে দেখে শুনে দেশে ফিরলেও ও আদতে কিছুই শিখে আসে না, কিছুই অনুশীলণ করে না। তাইতো ঢাকা শহরকে তারা দিন দিন আরো বেশী অনিয়মের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে ফেলেছে!
বেশী ভাড়া পাবার আশায় আবাসিক ভবনকে বাণিজ্যিক ভবনে রূপ দিয়ে জনগণের অসুবিধা ও বিরক্তি বাড়িয়ে তুলেছেন। প্রশাসনের নাকের ডগায় যানজট, শব্দজট, মশলার ঝাঁঝানি ও গভীর রাত অবধি খাদকদের কোলাহলে বিষিয়ে তুলেছেন আবাসিক এলাকার পরিবেশ।
আবাসিক ভবনকে বাণিজ্যিক ব্যবহারের সরকারী অনুমতি দেবার বা পাবার কোন আইন নেই। তাদেরকে ট্রেড লাইসেন্স দেবার কথা নয়। কিন্তু সবার নাক গলিয়ে সবকিছুই ম্যানেজড হয়ে যাবার নিয়ম চালু হয়ে গেছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে। তদ্বির আসে আইনপ্রণেতা বা রাজনৈতিক লবিং আসে উপরওয়ালাদের নিকট থেকে। সেসব তদ্বির পেলে নতজানু অথবা বেপরোয়া হয়ে যান তদারকি সংস্থাগুলোর কিছু ঘুসখোর ব্যক্তি।
রাজনৈতিক লবিং ও প্রশাসনিক লাইন ক্লিয়ার দেখলেই সেই সাথে তারা জুড়ে দেন নানা অন্যায় শর্ত। এসব অন্যয় শর্ত পূরণ করতে অপারগ হওয়া ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তারা তখন সরাসারি ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে আপোষ-রফা করে নিজেদের আখের গুছিয়ে ফেলেন। বেইলীর গ্রীণ কোজি ভবনে অগ্নি দুর্ঘটনার পর ৪৬ জন নিরীহ মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটলে বিভিন্ন তদারকী কর্তৃপক্ষের কিছু সৎ মানুষের মুখ থেকে ক্ষোভের মাধ্যমে বলা এসব কথা গণমাধ্যমে এসেছে।
প্রতিটি ঘটনা ঘটে যাবার পর তার কারণ হিসেবে অবহেলা, গাফলাতি ইত্যাতির নানা বয়ান শুনতে আমরা অভ্যস্ত। সেই সাথে কিছু নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করার রেওয়াজ খুবই ঘৃণিত একটি পন্থা। এতে প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করা হয় মাত্র। বাপার এক নেতার মতে, এসব নিরীহ ছোটখাটো হোটেল কর্মী বা ব্যবসায়ীরা দায়ী হলেও তাদের হোতাদেরকেও দায়ী করতে হবে। যারা এসকল বিষয় সরেজমিনে তদারকী করার দায়িত্বে রয়েছেন তারা এতদিন ধরে একটি ছোট্ট ভবনে ১২টি রেস্তোঁরা এবং সিঁড়র মধ্যে শত শত গ্যাস সিলিন্ডার, কেরোসিন, ডালডা-সয়াবিনের টিন রাখা দেখেও কেন সেটিকে সিলগালা করে দেয়নি- তার তদন্ত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এসব ভালনেরাবল রেঁস্তোরা ও গ্যাস, দাহ্য পদার্থ রাখা ভয়ংকর সিঁড়ির স্থানকে কেন এতদিন লালক্রস দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি?
এখন শোনা যাচ্ছে, গ্রীণ কোজি ভবনের রেঁস্তোরায় সেফটি বহির্গমণ সিঁড়ির ব্যবস্থা না থাকায় বার বার নোটিশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনদফা নোটিশ দেবার পর মালিক যদি দোকান খোলা রেখেই থাকে তাহলে কেন সেটা তালাবদ্ধ করে দেয়া হয়নি?
এদিকে ঘটনার পাঁচদিন পর শত শত রেষ্টুরেন্টেকে অবৈধ ঘোষণা করে সিলগালা করা ও ভেঙ্গে ফেলার কাজ শুরু করে দেশে হাজার হাজার নতুন বেকার বানানোর লাইসেন্স কে কাকে দিচ্ছে? ঢাকার সকল রেষ্টুরেন্টে হঠাৎ সিলগালা বা তালা ঝুলানোর জন্য এত তুলকালাম কান্ড করার পিছনে রহস্য কি? কর্মীদের বিকল্প কাজের চিন্তা না করে এত দ্রুত এসব হঠকারী ধ্বংসলীলার দায় কে নেবে? এই হঠকারীতা বেকারত্ব বাড়ানোর পাশাপাশি ঘুস-দুর্নীতিকে আরো উস্কে দিচ্ছে।
প্রতিটি বহুতল আবাসিক ও বানিজ্যিক ভবনে, রেঁস্তোরায়, ফায়ার এস্টিংগুইসার, একাধিক সেফ এক্সিট, ছাদের উপরে হেলিপ্যাড করার ব্যবস্থা করতে হবে। অগ্নিকান্ডের সময় হাজারো উৎসুক মানুষের ভীড় ঠেকানোর জন্য গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা ও জরিমানার বিধান জানানো দরকার।
যে কোন অগ্নিকান্ডের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া কঠিন। তাই এজন্য সারা পৃথিবীতে অগ্নিবীমাকে এক নম্বর প্রাধান্য দিয়ে বাধ্যতামূলক করা হয়ে থাকে। তিলোত্তোমা রাজধানীর মুখে, দেহে বার বার এত বেশী অগ্নিক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে তার ভয়াবহতা ও মানুষের জান-মালের আর্থিক ও সামজিক ক্ষতি পুষিয়ে নেবার জন্য দুর্ঘটনা বীমা থাকা জরুরী। বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে প্রচলিত বেসরকারী বীমা কোম্পানিগুলো এখনও ততটা জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি। তাই অগ্নিবীমাকে সরকারীভাবে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
একজন ক্ষুধার্থ মানুষ বা একটি সুখি পরিবার প্রিয়জনের প্রিয় দিনটি সেলিব্রেট করতে রেঁস্তোরায় গিয়ে খাবার টেবিল বসে হঠাৎ আগুন লেগেছে চিৎকার শুনে নিরাপদে সেখান থেকে বাইরের আলো বাতাসে বের হতে পারবে না এটা কোন ধরণের নিরাপত্তাহীনতা? কাঁচবন্ধ ঘরে খেতে বসে কার্বণডাই অক্সাইড অথবা মনোক্সাইডের প্রভাবে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে এটা বড়ই করুণ ও মার্মন্তিক উপাখ্যান।
নিমতলী, চুড়িহাট্টা, বসুন্ধরা শপিংমল, এফআর টাওয়ার, নারায়নগঞ্জের গার্মেন্টেসে তালাবদ্ধমৃত্যু, বঙ্গবাজার ইত্যাদি অগ্নিকান্ডের ক্ষতস্থানের ঘা না শুকাতেই আবারো এতবড় অগ্নিমৃত্যু আমাদের শহুরে জীবনের নিরাপত্তাহীনতাকে দেশী-বিদেশী কোন চক্রান্ত অবৈধ ম্যানেজের কাঠগড়ায় আবব্ধ করে ফেলেছে সেটি এখন দেখার সময়। দুর্নীতির ঘেরাটোপে আটকানো ঢাকার অগ্নিদুর্ঘটনায় পারস্পরিক দোষারোপের মুখোশ উন্মোচনের জন্য অনিয়মে আবদ্ধ আসল ঢাকনা সহসা খুলে দিতে আরো সৎ সাহসের জরুরী প্রয়োজন।
*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]