আনোয়ারা খাতুন শেফালী, নাটোর প্রতিনিধি :
নাটোরের লালপুরের এমপিওভুক্ত ৩টি বেসরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২৭ জন শিক্ষক-কর্মচারীসহ জেলায় মোট ১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২১৮ জন শিক্ষক কর্মচারীর ৪ মাস ধরে বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। সারাদেশে এ রকম ৬৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৯ শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর চার মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেনা না বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অধীনে থাকা এ সকল এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক কর্মচারীদের কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে স্থানান্তরের জন্য ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারে (ইএফটি) যুক্ত করেনি মাউশি। এতে গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে। সমস্যা সমাধানে দুই অধিদপ্তরের মধ্যে চিঠি চালাচালি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বেতন ভাতা না পাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা।
ভুক্তভোগী শিক্ষকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ২০২৪ সালের নভেম্বর মাস থেকে আমাদের বেতন ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি ঈদ বোনাস ও বৈশাখী ভাতাও পাইনি। কবে পাবো তাও জানা নেই। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধিন সারাদেশে এরকম ৬৩টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (এইচএসসি ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা টেকনোলজি-বিএমটি, এসএসসি ভোকেশনাল এবং কৃষি ডিপ্লোমা) শিক্ষাক্রমের ৯ শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী এই সমস্যার সম্মুখীন হয়ে অতি কষ্টে দিন পার করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৫ সালে মাউশির অধীনে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিওভুক্তি শুরু হয়। ২০০৯-২০১০ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয় যে, বেসরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে দেওয়া হবে। সে সময় মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে এ সকল প্রতিষ্ঠান কারিগরি অধিদপ্তরে স্থানান্তর করে মাউশি। কিন্তু ভুলক্রমে ১৫০টি প্রতিষ্ঠান মাউশিতে থেকে যায়। পরে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে অনেক প্রতিষ্ঠানকে আবার কারিগরিতে স্থানান্তর করা হলেও ৬৩টি প্রতিষ্ঠানের আংশিক শিক্ষক-কর্মচারী মাউশির অধীনে থেকে যান।
এদিকে ২০২৪ এর নভেম্বর থেকে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ইএফটিতে দেওয়া শুরু হয়। নতুন এ পদ্ধতিতে ৬৩ টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯ শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী যুক্ত হতে পারেননি। তখন ইএফটিতে যুক্ত হতে মাউশিতে যোগাযোগ করেন তারা। ইতিমধ্যে তাদের বেতন ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। পরে মাউশি ৬৩টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে ও মতামত চেয়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে চিঠি দেয়। এসব চিঠি চলাচলের মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বলেন, মাউশি নিয়ন্ত্রিত কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা চার মাস ধরে বেতন, ঈদ বোনাস, বৈশাখী ভাতা কিছু পাননি। এমন ৬৩টি প্রতিষ্ঠানের বিল মাউশি থেকে হতো। এখন বলছে এ বিল কারিগরি অধিদপ্তর দেবে। অধিদপ্তর পরিবর্তনের নামে আমাদের বেতন-বোনাস সব আটকে আছে।
গত রোববার (২০ এপ্রিল ২০২৫) কারিগরি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকদের সাথে সাক্ষাৎ করেন ৬৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ও শিক্ষকগণ। ওই দিনই মাউশির মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলেন কারিগরি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
শনিবার (২৬ এপ্রিল ২০২৫) কারিগরি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সাথে সাক্ষাতের সময় উপস্থিত ছিলেন নাটোরের লালপুর উপজেলার মঞ্জিলপুকুর কৃষি, কারিগরি ও বাণিজ্যিক মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. সাইফুল ইসলাম রিপন। তিনি বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও আমাদের কৃষি ডিপ্লোমা শাখা এক অধিদপ্তর থেকে অন্য অধিদপ্তরে স্থানান্তরের নামে আমাদের ১৯ জনের মধ্যে ১৮ জন শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। ইএফটি চালুর পর মাউশির অধীনে থেকেও আমরা এ পদ্ধতিতে যুক্ত হতে পারিনি।
বাগাতিপাড়ার চাঁদপুর টেকনিক্যাল এন্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ মো. মকবুল হোসেন জানান, তাঁর কলেজের এইচএসসি ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা টেকনোলজি (বিএমটি) শিক্ষাক্রমের ১৬ জনের মধ্যে ৬ জন শিক্ষক-কর্মচারী বেতন পাচ্ছেন না। মন্ত্রণালয়ের কারণে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
সিরাজগঞ্জ সদরের যমুনা কারিগরি ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ মো. আব্দুল মতিন তালুকদার বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানে এসএসসি (ভোকেশনাল) শাখায় ৬টি ট্রেডে ২৬ জন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। তাঁদের কেউ বেতন-ভাতা না পাওয়ায় অনেক কষ্টে দিন পার করছেন।
নাটোরের লালপুরের মোহরকয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রমজান আলী বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের এসএসসি (ভোকেশনাল) শাখার ১০ জন শিক্ষক-কর্মচারী ইএফটিতে মাউশি থেকে গত নভেম্বর মাসে বেতন উত্তোলন করেন। এর পর থেকে ১০ জনের কেউ আর বেতন পাচ্ছেন না। ইতিমধ্যে অধিদপ্তর থেকে চাহিদার ভিত্তিতে সকল তথ্য পাঠানো হয়েছে। এখনো কোন ফলাফল মেলেনি।
রাজশাহীর বাঘা মহিলা বাণিজ্যিক মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আবু বকর মোহাম্মদ সিদ্দিক বাবলু বলেন, সারা দেশে এই রকম ৬৩টি প্রতিষ্ঠান কারিগরি অধিদপ্তরে যুক্ত করা হচ্ছে জানিয়ে ইএফটিতে যুক্ত করেনি মাউশি। ইতিমধ্যে আমরা কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। আমরা অপেক্ষায় আছি।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (এমপিও) মো. খোরশেদ আলম বলেন, আমরা সমস্যাটি নিয়ে কাজ করছি। ইতিমধ্যে শিক্ষক-কর্মচারীদের নাম, পদবীসহ তালিকা চেয়ে মাউশিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তালিকা পেলে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বাজেট চাওয়া হবে। বাজেট পেলে দ্রুত এ সকল শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ভাতা দেওয়া হবে। তবে এটা কবে হবে তা বলতে পারব না।
এ বিষয়ে মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক উইং) অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল জানান, ইতিমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা দেওয়া হয়েছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের তালিকাও দিয়ে দেওয়ার কথা। দ্রুত সমস্যাটি সমাধানে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আমি বাইরে মিটিংয়ে থাকায় এখন কথা বলতে পারছি না। পরে বিষয়ে কথা বলব।