সোমবার | ২৮ জুলাই, ২০২৫ | ১৩ শ্রাবণ, ১৪৩২

মৃত্যুহীন প্রাণ মোহাম্মদ আবদুল মোবারক

শেখ ইউসুফ হারুন :
২০ জুলাই ২০২৫ তারিখ প্রত্যুষে ১৯৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তা ঝিনাইদহ ও যশোর জেলার দীর্ঘ সময়ের জেলা প্রশাসক আমিনুর রসুল স্যারের ফেসবুকের ওয়াল থেকে জানতে পারি একই ব্যাচের কর্মকর্তা ঢাকার প্রাক্তন জেলা প্রশাসক ও নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক ২০ জুলাই ২০২৫ তারিখ সকাল ৭:৫০মিঃ চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা । মহান আল্লাহতায়ালা যেন তাঁকে বেহেসতের সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করেন।
চাকরি জীবনে মোবারক স্যারের সান্নিধ্য পেয়েছি বহুবার। তিনি ছিলেন সিভিল সার্ভিসের আইকন, আমার ‘আইডল’। সিভিল সার্ভিসে তিনি নিজের ভাবর্মূতি এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, অনেকেই তাঁকে ‘আইডল’ হিসেবে মনে করতেন। মোবারক স্যারের সান্নিধ্যে যারা কাজ করছেন তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন ‘সুশীল সেবক’ হিসেবে তাঁর সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, জ্ঞান, প্রাজ্ঞতা ও ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ। অধীনস্তদের পরিচালনা ও সহযোগিতা ছিল অতুলনীয় ও অনুকরণীয়।
জনাব মোহাম্মদ আবদুল মোবারক চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার ছিপাতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম আব্দুর রহমান এবং মাতা মরহুমা সুফিয়া খাতুন। তিনি স্থানীয় আলী মোহাম্মদ প্রাইমারী স্কুল হতে প্রাথমিক ও হাটহাজারী পার্বতী মডেল স্কুলে মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ালেখা সমাপ্ত করেন। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি ১নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসে (আইএমএস) যোগদান করেন। পরে ঐ সার্ভিসটি বিলুপ্ত হলে তিনি বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে আত্মীকৃত হন। তাঁর বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে চাকুরি ঘটনাবহুল। তিনি অনেক ঘটনার সাক্ষী-যা বর্তমান কর্মকর্তাদের জন্য অনুকরণীয় বা অনুসরণীয় হতে পারে।
১৯৮৫ সালের ঘটনা। মোবারক স্যার তখন লক্ষীপুর জেলার রামগতি উপজেলার ইউএনও। তখন চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার আব্দুল মুহিত চৌধুরী। কোন কারণে তিনি কমিশনারের সাক্ষাতপ্রার্থী হয়ে তাঁর অফিসে গমন করেন। কমিশনারের একান্ত সচিবের সাথে যোগাযোগ করে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে ‘স্লিপ’ প্রদান করেন। তিন ঘন্টা অপেক্ষা করার পরও কমিশনার তাকে না ডাকায় তিনি সাক্ষাত না করে চলে আসেন। এদিকে তিন ঘন্টা পরে কমিশনার তাকে ডাক দিলে একান্ত সচিব বলেন যে, “তিনি চলে গিয়েছেন”। তখন কমিশনার ক্ষেপে যেয়ে বেয়াদব ইউএনও’কে শায়েস্তা করার জন্য ‘শোকজ’ করেন এবং এর অনুলিপি চট্টগ্রাম বিভাগের (বর্তমান সিলেটসহ) সকল জেলা প্রশাসক ও ইউএনও-দেরকে প্রদান করেন। মোবারক স্যারও কম যান না। তিনি ঘটনার দিনের একটি মেডিকেল সার্টিফিকেট জোগাড় করে শোকজের জবাবে বলেন যে, “দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে থাকতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে ডাক্তারের নিকট চিকিৎসা নিয়ে কর্মস্থলে চলে আসেন। কমিশনার বিষয়টি নিয়ে আরা বাড়াবাড়ি করেননি”।
১৯৯৭ সালের ঘটনা। মোবারক স্যার তখন ঢাকার জেলা প্রশাসক। সাভারে ইপিজেড সম্প্রসারণের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। ভূমি মালিকগণ বেশি ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির আশায় অবৈধভাবে ছোট ছোট ঘরবাড়ি নির্মাণ করেন। কিন্তু ঢাকা জেলা প্রশাসন ভূমি মালিকদের প্রাথমিক নোটিশ জারির পূর্বে সমগ্র এলাকার স্থিরচিত্র ও ভিডিও ধারণসহ সরেজমিন প্রতিবেদন প্রস্তুত করে রাখে। উক্ত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে জেলা প্রশাসন অবৈধভাবে ঘর নির্মাণকারীদের রোয়েদাদে অন্তর্ভুক্ত করা হতে বিরত থাকে। ভূমি মালিকগণ বিভিন্নভাবে তদবির করে রোয়েদাদে ঘরের মূল্য অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হন। এরমধ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইপিজেড এলাকায় জনসভার তারিখ নির্ধারণ করেন। তদবীরকারকগণ প্রধানমন্ত্রীর নিকট জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে নালিশ দায়ের করেন। তারা প্রধানমন্ত্রীকে বুঝাতে সমর্থ হন যে, জেলা প্রশাসক, ঢাকা ইচ্ছা করে ঘরের ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন না। জনসভার দিন প্রধানমন্ত্রী জেলা প্রশাসক জনাব আবদুল মোবারককে ভূমি মালিকদের ঘরের ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ প্রদান করেন। জেলা প্রশাসক আবদুল মোবারক বিনীতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, “স্যার, ভূমি মালিকরা বেশি ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির আশায় প্রাথমিক নোটিশ জারির পর অবৈধভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণ করেছেন। আমি গরীব মানুষ, এদেরকে অবৈধভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদান করলে আমার চাকুরি চলে যাবে। আমি পরিবার নিয়ে কোথায় যাবো, খাবো কী?”। এরপর প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে আর কথা বাড়াননি। জেলা প্রশাসককেও আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়নি।
১৯৯০ সালের কথা। মোবারক স্যার তখন সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট- থাকেন ষোলঘর কলোনিতে। কোন একরাতে চোরেরা স্যারের বাসার গ্রিল ভেঙ্গে বাসার জিনিষপত্র চুরি করে নিয়ে যায়। তিনি অজ্ঞাত চোরদের বিরুদ্ধে থানায় এজাহার দায়ের করেন। পুলিশ চুরির কোন ‘ক্লু’ বের করতে অসমর্থ হয়। কোন একদিন স্যার অফিস হতে বাসায় যাচ্ছিলেন। তিনি গাড়ি হতে লক্ষ্য করেন, এক রিক্সাওয়ালা তাঁর জামা পরিধান করে রিক্সা চালাচ্ছে। তাৎক্ষণিক তিনি গাড়ি হতে নেমে রিক্সাওয়ালাকে আটক করেন এবং সদর থানার ওসিকে সংবাদ দেন। ওসি সাহেব হাজির হলে তিনি তাকে বলেন, “আপনারা তো চোর ধরতে পারলেন না, আমি ধরেছি। থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করুন”। পুলিশরা পরে রিক্সাওয়ালাকে জেরা করে সম্পূর্ণ চোর চক্রকে ধরে ফেলে। স্যার চুরি যাওয়া নিজের কিছু কিছু জিনিষ ফেরত পেয়েছিলেন।
১৯৮৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর তারিখে আমরা চারজন সহকারী কমিশনার সুনামগঞ্জ কালেক্টরেটে যোগদান করি। আমি ছাড়া অন্যরা হলেন স. ম. আশরাফুজ্জামান, মোঃ সিরাজুল ইসলাম ও মোহাম্মদ ইব্রাহীম। সে সময় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোবারক স্যার প্রশিক্ষণে ছিলেন। কিছুদিন পরে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কর্মে যোগদান করেন। এরপর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জনাব নজরুল ইসলাম প্রশিক্ষণে যান। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এঁর নৈমিত্তিক প্রতিভূ ছিলেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল মোবারক স্যার। কয়েকদিন পরে রমজানের ঈদ। চাকুরিতে যোগদানের পর প্রথম ঈদ বিধায় আমরা ঠিক করলাম সকলে ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাবো। অনেক সাহস সঞ্চয় করে মোবারক স্যারের কাছে গেলাম এবং আমাদের মনের অভিপ্রায় বর্ণনা করলাম। স্যার বললেন, “আপনাদের চারজনের মধ্যে দুইজন যাবেন এবং দুইজন থাকবেন। আপনারা নিজেদের মধ্যে ঠিক করে আসুন-কোন দুইজন ছুটিতে যাবেন আর কোন দুজন থাকবেন”। (তিনি সাধারণতঃ অধীনস্তদের আপনি করে সম্বোধন করতেন) আমরা নিরাশ হয়ে ফিরে এলাম। কিন্তু নিজেদের মধ্যে আলাপ করে কোন সিদ্ধান্তে আসা গেল না। কারণ কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি হয়নি। কয়েকদিন পরে এক সন্ধ্যায় চারজন মিলে সাহস করে জেলা প্রশাসকের বাংলোতে গেলাম। তখন জেলা প্রশাসক ছিলেন জনাব মোঃ ইয়াকুব আলী। তিনি আমাদের খোঁজ খবর নিলেন এবং আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। বিদায়ের পূর্বে সহকর্মী আশরাফ আমাদের মনের কথাটি ব্যক্ত করলেন। তিনি বললেন, “স্যার ঈদে আমরা বাড়ি যেতে চাই”। উত্তরে জেলা প্রশাসন বলেন, “যাবে অসুবিধা কী?”। তখন আশরাফ বললেন, “এডিএম স্যার আমাদের চারজনের মধ্যে দুজনকে যেতে বলেছেন এবং দুজনকে থাকতে বলেছেন”। জেলা প্রশাসক বলেন, “তোমাদের তো এখন তেমন কাজ নেই। তোমরা চারজনই যাবে। আমি মোবারককে বলে দিচ্ছি”। এরপর তিনি সি,একে মোবারক স্যারকে টেলিফোনে লাগাতে বললেন। তিনি তাঁকে বললেন, “ওরা প্রবেশনার, এখনও তেমন কোন কাজ নেই। চাকরিতে যোগদানের পর প্রথমবার ঈদ এসেছে। ওরা চারজন যাবে এবং ২/১ দিন আগেই যাবে”। আমরা তো মহাখুশি। পরের দিন ছুটির আবেদন রেখে বাসের টিকিট কেটে যার যার মতো বাড়ি চলে গেলাম। ছুটি শেষে অফিসে যোগদানের পর এডিএম মোবারক স্যারের পিয়ন এসে আমাদেরকে বললো, “স্যার, আপনাদেরকে সালাম দিয়েছেন”। আমরা ভীরুপায়ে স্যারের চেম্বারে হাজির হলাম। স্যার তখন বই পড়ছেন। আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম। তিনি বই থেকে মুখ না তুলেই ইশরায় আমাদেরকে বসতে বললেন। তবে তাঁর চেহারা দেখে আমরা অনুমান করলাম তিনি ভীষণ ক্ষেপে আছেন। একটু পর তিনি বই থেকে মুখ তুলে আমাদেরকে বললেন, “আপনাদের দুইজনকে বাড়ি যেতে বলেছিলাম। আপনারা সবাই গেলেন কেন?” তখন আমরা বললাম, জেলা প্রশাসক স্যার আমাদেরকে যেতে বলেছেন। তখন তিনি বললেন, “ও চাকরিতে যোগদান করতে পারলেন না জেলা প্রশাসক চিনেছেন? এজন্য আপনাদেরকে ভুগতে হবে”। যাহোক আমরা মন খারাপ করে স্যারের চেম্বার হতে বের হলাম। পরের দিন সংস্থাপন শাখা হতে আমাদের প্রত্যেকের নামে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হলো। আমরা তো ভয়ে অস্থির। সিনিয়রদের সাথেও বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলাম। তারা বললেন, “ভাল করে লিখে উত্তর দাও”। আমরা তাই করেছিলাম। এরপর কী হয়েছে জানিনা। তবে শুনেছি জেলা প্রশাসক আমাদেরকে ছুটি দেয়ায় তিনি আর কিছু করেননি। শাস্তি দেয়া নয় বরং নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা আদেশ অমান্য করে তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা যে ‘ইন-সাবঅর্ডিনেশন’ বা অবাধ্যতার সামিল সেটি তিনি আমাদেরকে বুঝাতে চেয়েছেন।
১৯৯০ সালের কথা বলছি। আমরা সুনামগঞ্জে যোগদানের কিছুদিন পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন শুরু হয়। বিভিন্ন দিনে উপজেলা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। আমরা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন উপজেলায় দায়িত্ব পালন করি। দিরাই উপজেলায় নির্বাচনে আমাদের নিয়োগ করা হলে নির্বাচনের আগের দিন আমার সেখানে গমন করি। উপজেলা নির্বাচন তদারকির জন্য এডিএম আবদুল মোবারক দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তখন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন জনাব মাইনউদ্দীন খন্দকার। তিনি পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও কারা মহাপরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সকল প্রিজাইডিং অফিসারদের নির্বাচনী মালামাল বুঝিয়ে দেওয়ার পর রাত্র ৮:০০টায় মোবারক স্যার ব্রিফিং এর জন্য ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে নিয়ে বসলেন। তিনি হঠাৎ আমাকে বললেন, “ইউসুফ হারুন আপনার কলম ও নোটবই কোথায়?” আমি হঠাৎ করে সভায় যোগদান করায় কলম ও কাগজ আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। স্যারের কথায় আমি চরম বিব্র্রত ও লজ্জিত হলাম। তিনি তখন আমাকে বললেন, “শিক্ষিত মানুষের পকেটে কলম থাকে না। নিশ্চিয়ই আপনার সার্টিফিকেটে গণ্ডগোল আছে”। এত অফিসারের সামনে আমাকে এরকম করে বলায় আমি চরম বিব্রত হই এবং লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে থাকি। এরপর চাকরি জীবনে আর কোনদিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে গেলে কলম ও নোটবই ছাড়া যাইনি। আজকাল দেখি অনেক কর্মকর্তা তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে দেখা করতে গেলেও পকেটে কলম বা নোটবই থাকে না। কোন প্রকার বকাবকি না করে তিনি আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছিলেন তা অনেকের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।
জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে শেষ হয়েছে। বিজয়ী ও বিজীত প্রার্থীদের মধ্যে ভোটের ব্যবধান খুবই কম। এটি নিয়ে উপজেলায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। নির্বাচনের পরের দিন পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকগণ উপজেলা পরিষদের সামনে বিরাট মিছিল নিয়ে এসে এডিএম মোবারক স্যারকে ঘেরাও করেন। মোবারক স্যার ঘেরাও এর মধ্যে একটি চেয়ারে বসে বই পড়ছেন। ঘেরাওকারীরা নিয়মিত বিরতিতে শ্লোগান তুলছেন। এভাবে প্রায় ৩/৪ ঘন্টা কেটে গেল। সকাল গড়িয়ে দুপুর এবং দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। তবুও এডিএম সাহেবের বই পড়া শেষ হলো না। ইউএনও সাহেব কয়েকবার দুপুরের খাবারের জন্য তাগিদ দিলেও তিনি তাতে সাড়া দিলেন না। মাঝে মধ্যে সিগারেট টানছেন আর বই পড়ছেন। আর এই নির্বিকার ভাব দেখে ঘেরাওকারীরা বিরক্ত হয়ে আস্তে আস্তে প্রস্থান করে। একটি কথাও না বলে এতবড় একটি ‘মব’ তিনি যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন, তা বর্তমান পরিস্থিতিতে বিস্ময় বটে।
১৯৯০ সালের ঘটনা। সুনামগঞ্জে ষোলঘর মাদরাসা কেন্দ্রে দাখিল পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষায় নকল ও দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আমাকে নিয়োগ করা হয়। পরীক্ষা চলাকালে একজন পরীক্ষার্থীকে বইয়ের পাতা হতে নকলরত অবস্থায় আবিস্কার করি। খাতার সাথে মিলিয়ে দেখা যায়, তিনি হুবহু বইয়ের পাতা হতে নকল করছেন। আমি বইয়ের পাতাটি পর্যবেক্ষণে দেখতে পাই, বইয়ের পাতাটির একদিকের পৃষ্ঠায় কলম দিয়ে ‘ক্রস’ দেয়া আছে। পরীক্ষার্থী অন্য পৃষ্ঠা হতে নকলরত অবস্থায় ধৃত হয়। আমি কক্ষ পরিদর্শককে তাকে বহিষ্কারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করি। একটু পরে ঐ কক্ষ পরিদর্শক এসে আমাকে বলেন যে, “স্যার খাতার সাথে নকল মিলছে না”। ভাল করে পরীক্ষা করে দেখি, কক্ষ পরিদর্শক আমি যে নকলটি (পিছনে ‘ক্রস’ চিহ্ন দেয়া) সেটি সরিয়ে অন্য একটি বইয়ের পাতা নিয়ে এসেছেন। আমি তখন তাকে বলি, “আমি তো মিলিয়ে দিলাম। সে পাতাটি কোথায়?”। সে তখন আমতা আমতা করতে থাকে। আমি কেন্দ্র সচিবকে ডাকি এবং কক্ষ পরিদর্শকের “বডিসার্স” করতে বলি। তার পাঞ্জাবীর পকেট হতে আমার ধরা সেই নকলটি কেন্দ্র সচিব আবিষ্কার করেন। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে টেলিফোনে এডিএম মোবারক স্যারকে জানালে তিনি আমাকে অভিযুক্ত শিক্ষক ও কেন্দ্র সচিবকে যেন গাড়ি দিয়ে তার চেম্বারে পাঠিয়ে দিতে বলেন। পরে জানতে পারি মোবারক স্যার ঐ শিক্ষককে নিজহাতে স্বীকারোক্তি লিখিয়ে বহিষ্কার করেন।
আমরা চারজন ৮ম ব্যাচের কর্মকর্তা সুনামগঞ্জে যোগদান করি, যা আগেই বলেছি। অফিসের কাজকর্মের পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেসি শিখছি মোবারক স্যারের কাছে। তিনি প্রতিদিন কোর্ট শেষে আমাদের নিয়ে বসতেন। ফৌজদারী কার্যবিধি ও দন্ডবিধির ৪টি করে ধারা আমাদেরকে পড়া দিতেন। পরেরদিন ধারাগুলি মুখস্ত করে আসতে হতো। কেউ না পারলে তিনি ভদ্র ভাষায় যে গালি দিতেন, তাতে পরের দিন মুখস্ত না করে আসা যেত না। তাছাড়া ফৌজদারী কার্যবিধির ১০৭, ১৩৩, ১৪৪, ১৪৫ ধারার অর্ডারসিট, অভিযোগ গঠন, আসামী পরীক্ষা, রায় লেখা ইত্যাদি বিষয় তিনি হাতে-কলমে আমাদেরকে শিখিয়েছেন। ম্যাজিস্ট্রেসি বলতে যা বুঝায় তা মোবারক স্যারের কাছ হতে শিখেছি। তিনি উপজেলা কোর্ট পরিদর্শনে গেলে আমাদের কাউকে না কাউকে সঙ্গে করে নিতেন। পরিদর্শনের সময় খুটিনাটি ভুল-ক্রটি তিনি আমাদের সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিতেন। একবার মনে পড়ে ছাতকের উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পরিদর্শনে আমাকে নিয়ে যান। তখন উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ৮৪ ব্যাচের মরহুম সালাউদ্দিন মাহমুদ স্যার (পরে মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক)। মোবারক স্যার উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট সালাউদ্দিন স্যারকে জিজ্ঞাসা করেন, সংক্ষিপ্ত বিচার ফৌজদারী কার্যবিধির কত ধারায় অনুষ্ঠিত হয়। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বলতে না পারায় বকাবকি করেন। এভাবেই তিনি সকলকে শিক্ষা দিতেন। পরবর্তী জীবনে স্যারের শিখানো জ্ঞান প্রয়োগ করে ম্যাজিস্ট্রেসিতে অনেক সুনাম অর্জন করেছি। তাঁকে কোন দিন সাক্ষী ফেরত দিতে দেখিনি। সন্ধ্যার পরে মোমবাতি জ্বালিয়ে তিনি সাক্ষীর ‘ডিপোজিশন’ লিপিবদ্ধ করতেন। রায়গুলি নিজহাতে সুন্দর করে লিখতেন। স্যারের লেখা রায় ছিল সত্যিই অসাধারণ।
১৯৯৮ সালের দিকে আমি তখন হবিগঞ্জে সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও ১ম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। একদিন দুর্নীতি দমন ব্যুরো সিলেট হতে এটি ফ্যাক্স পেয়ে জানতে পারি সুনামগঞ্জের স্পেশাল জজ আদালতে জনৈক ব্যক্তি জগন্নাথপুর উপজেলার একটি নামজারি মামলা সংক্রান্তে আমি, এএসওসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ‘দি ক্রিমিনাল ল এমেন্ডমেন্ট এ্যাক্ট, ১৯৫৯’ এর কয়েকটি ধারায় সি.আর মামলা করেছে। আদালত জেলা দুর্নীতি দমন কর্মকর্তা (DACO), সুনামগঞ্জকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিলে DACO আমার অজ্ঞাতেই কাগজপত্র পর্যালোচনা করে কোন ‘ক্রিমিনাল লায়াবিলিটি’ নেই বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। বাদী তার বিরুদ্ধে নারাজী দিলে আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে মহাপরিচালক, দুর্নীতি দমন ব্যুরেকে ‘স্যাংশন’ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করে। ব্যুরো হতে তদন্ত করে পুনরায় প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য জেলা দুর্নীতি দমন কর্মকর্তা সিলেটকে বলা হয়। DACO সিলেট একইভাবে তদন্ত করে সুনামগঞ্জের জেলা দুর্নীতি দমন কর্মকর্তার অনুরুপ মন্তব্য করে ব্যুরোতে প্রেরণ করেন। মহাপরিচালক প্রতিবেদন প্রাপ্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতিবেদনটি প্রেরণ করেন। কারণ উক্ত আইনের বিধান মোতাবেক সে সময় আমার পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ‘স্যাংশন’ দেওয়ার ক্ষমতাবান ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব। আইনের বিধান এরকম যে ৬০ দিনের মধ্যে ‘সাংশন’ না দিলে আদালত ধরে নিবে যে ‘স্যাংশন’ দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে চরম হয়রাণির মধ্যে পড়তে হতো। মোবারক স্যার তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক। আমি স্যারের সাথে দেখা করলে তিনি কাগজপত্র দেখে বলেন, “এই নামজারীর কারণে আপনার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার কথা নয়। ৬০ দিন পেরোতে অল্প কয়েকদিন বাকি আছে, দেখি কী করা যায়”। স্যার, ব্যুরোর পত্রটি তাঁর পরিচালক জনাব উ.ক্য.জেনকে নথিতে উপস্থাপনের জন্য বললেন। কোন কারণে তিনি দেরি করায় স্যার তাঁকে ইন্টারকমে বললেন, “আপনি নথিটি আমার কাছে দিচ্ছেন না কেন”? পরিচালক মহোদয় বললেন, “স্যার এটি পর্যালোচনার জন্য রেখেছি”। তখন মোবারক স্যার বললেন, “পর্যালোচনা যা করার আমি করবো। আপনি শুধু নথিটি উপস্থাপন করে আমার কাছে দিন। ইউসুফ হারুন আমার সহকর্মী। ওকে আমি চিনি”। স্যারের চেষ্টায় ৫৯তম দিনে মুখ্য সচিব ড. এস.এ সামাদ ‘স্যাংশন’ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন। মোবারক স্যার ‘স্যাংশন’ না দেওয়ার সিদ্ধান্তটি সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের নিকট ফ্যাক্সে পাঠিয়ে তক্ষুনি স্পেশাল জজ আদালতে প্রেরণ করতে বলেন। আমি বিরাট একটি বিপদ হতে রক্ষা পাই। জুনিয়রদের বিপদে আবদুল মোবারক স্যার এমনভাবে পাশে দাঁড়াতেন-যা অনুকরণীয় বটে।
ঢাকার জেলা প্রশাসক থাকাকালে আমি ‘কনটেম্প’ মামলা নিয়ে অনেকবার বিপদে পড়েছি। স্যার তখন রমনা থানার পাশে একটি ফ্লাটে থাকতেন। অনেকবার স্যারের বাসায় গিয়েছি। তিনি পরম মমতায় আমাকে আদর-আপ্যায়ন করেছেন। তিনি আমাকে শিক্ষকের মতো করে পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকি মামলার জবাব পর্যন্ত লিখে দিয়েছেন। শুধু আমি নই অনেক সহকর্মী স্যারের এরকম সহযোগিতা পেয়েছেন। প্রথমে তিন বকাঝকা করতেন। বলতেন, আজকালকার কর্মকর্তার পড়ালেখা করে না শিখবে কী করে? কিন্তু পরে তিনি সুন্দর সমাধান বলে দিতেন। বাইরে শক্ত খোলশ থাকলেও ভিতরে তিনি ছিলেন অসম্ভব কোমল হৃদয়ের মানুষ।
পড়ালেখা করা ছিল মোবারক স্যারের চিরদিনের অভ্যাস। তিনি এমন এমন বই পড়তেন যেগুলির নাম পর্যন্ত কোনদিন শুনিনি। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় ‘আবদুল্লাহ’ গ্রন্থের রচয়িতা কাজী এমদাদুল হকের পুত্র কাজী আনোয়ারুল হকের লেখা ‘Under Three Flags’ বইটির নাম স্যারের নিকট হতে শুনেছি। The Art of Writing Judgments by Justice P S Narayanan বইটি স্যারের কাছ হতে নাম শুনে সংগ্রহ করেছিলাম। তাছাড়া ফৌজদারী বিচারের ক্ষেত্রে ১৯২০ সালে প্রকাশিত A Textbook of Medical Jurisprudence and Toxicology by Rai Bahadur J.P.Modi বইটি যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা স্যারের কাছ হতে শুনেছি। স্যারের ইচ্ছায় সুনামগঞ্জ কালেক্টরেটের লাইব্রেরিতে সেটি সংগ্রহ করেছিলাম। তিনি প্রায়ই বলতেন, “ছাত্রজীবনে পড়ালেখার সুযোগ পাইনি। চাকরিতে এসে সে ঘাটতি মিটানোর চেষ্টা করছি”। স্যারের জ্ঞানের তৃষ্ণা ছিল অপরিসীম।
স্যার দীর্ঘদিন যাবৎ ক্যান্সারে ভুগছিলেন। তিনি তাঁর ঢাকার ফ্লাটটি বিক্রি করে চট্টগ্রাম চলে যান। ২০২৪ সালের মে মাসের প্রথমদিকে যখন আমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান, স্যার আমাকে টেলিফোন করে বলেন, “ইউসুফ হারুন আমি একদিন মিরসরাই যেতে চাই। ওখানে আপনারা কী করছেন জানতে ইচ্ছা করে”। আমি বলি, “স্যার আমি সময় করে আপনাকে মিরসরাই নিয়ে যাবো”। কিন্তু আমি স্যারকে মিরসরাই নিয়ে যেতে পারিনি। এরপর জুলাই মাসের প্রথমদিকে আমার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। স্যারের নিকট আমার দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারিনি। এ অপারগতার কষ্ট থাকবে আমৃত্যু। স্যার নিশ্চয়ই পরপার হতে আমাকে ক্ষমা করবেন।
মোবারক স্যার, সুনামগঞ্জ হতে নোয়াখালী জেলায় বদলী হয়ে চলে যান। এরপর তিনি ঢাকা জেলার এডিএম হয়েছিলেন। প্রথমে শেরপুরের জেলা প্রশাসক ও পরে ঢাকার জেলা প্রশাসক হন। ১৯৯২ সালে তিনি উপ-সচিব হিসেবে পদোন্নতি প্রাপ্ত হয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্র্রণালয়ে কিছুদিন কাজ করেন। ১৯৯৬ সালে সরকার পরিবর্তন হলে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম) এঁর পিএস হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। মোবারক স্যার মুক্তিযুদ্ধে মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম (বীরউত্তম) এর অধীনে ১নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন। যুগ্ম-সচিব হিসেব পদোন্নতি প্রাপ্ত হয়ে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়েও কিছুদিন কাজ করেন। তিনি মহাপরিচালক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চাকরি করেন। পরে ২০০১ সালে বিএনপি সরকার তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করেন। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তৎপূর্বে তিনি আইন কমিশনের সদস্য ছিলেন। মানুষের জীবনে ভুল-ভ্রান্তি থাকে। কেউ একশতভাগ খাঁটি মানুষ নন। ভাগ্যের লিখন কেউ খন্ডন করতে পারে না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মৃত্যুর পরে’ কবিতার এই চরণগুলি মোবারক স্যারের বেলায় সমার্থক হতে পারেঃ
জীবনের ভুলভ্রান্তি
সব গেছে চুকে।
রাত্রিদিন ধুক্‌ধুক্
তরঙ্গিত দুঃখসুখ
থামিয়াছে বুকে।
মৃত্যুহীন প্রাণ মোহাম্মদ আবদুল মোবারক ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে থেকে সিভিল সার্ভিসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন -এই কামনা করি।

* শেখ ইউসুফ হারুন : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান।

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.