-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
গত ২৮ মার্চ সকালে মিয়ানমারে অল্প সময়ের ব্যবধানে ৭ দশমিক ৭ এবং ৬ দশমিক ৪ মাত্রার দুটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এই কম্পনের প্রভাবে মিয়ানমার একপাশে থাইল্যান্ড ও অন্যপাশে বাংলাদেশও তীব্র ঝাঁকুনি অনুভব করে। এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল মিয়ানমারের মান্দালয় শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে, ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। এতে সাগাইং, মান্দালয়, নেইপিদোসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই শক্তিশালী ভূমিকম্পে ইরাবতী নদীর ওপর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত আভা সেতু ধসে পড়েছে। ৯১ বছর বয়সী এই সেতু পুরোনো ‘সাগাইং’ সেতু নামেও পরিচিত। ভূমিকম্পের এ ঘটনার ০৭ দিন পর পর্যন্ত ৩৩৫৪ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন ।
মিয়ানমারে ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানার পর যুদ্ধবিরতি ভেঙে কমপক্ষে ১৪টি আক্রমণ চালিয়েছে জান্তা সরকার। বিদ্রোহীদের সাথে ২২ এপ্রিল, ২০২৫ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকার কথা জানান তিনি। তবে ধরে রাখতে পারলেন না নিজের পাশবিকতা। তাই তাদের কাছে ভূমিকম্পের চেয়ে সবচেয়ে বড় ভয় জান্তা সরকার।
প্রথম ভূমিকম্পের ১২ মিনিট পর ৬.৪ মাত্রার আরেকটি পরাঘাত বা ‘আফটারশক’অনুভূত হয়, যার কেন্দ্রস্থল সাগাইং থেকে ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণে। এই ভূমিকম্পের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, মান্দালয় হইতে প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার দূরের থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের বহুতল ভবনগুলিও কেঁপে ওঠে। মার্কিন ভূতাত্তি¡ক জরিপ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী শহর নেইপিদো থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরবর্তী সাগাইং শহরে ১৬ থেকে ১৮ কিলোমিটার ভূ-অভ্যন্তরে এই কম্পনের উৎপত্তি।
এবারে সংঘটিত ভয়াবহ ভূমিকম্পে সাগাইংয়ে শত বছরের পুরোনো একটি সেতু ধসে পড়েছে এবং বিভিন্ন স্থানে ভবন, সুউচ্চ প্যাগোডা ও মসজিদ ধ্বংস হয়েছে। ভূমিকম্পের পর মিয়ানমারের ৬টি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। দেশটির সামরিক সরকার আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য আবেদন করেছে এবং উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে তথ্য প্রবাহে সীমাবদ্ধতা থাকায় সঠিক পরিস্থিতি নিরূপণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এই ভূমিকম্পের প্রভাবে থাইল্যান্ডের প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের আবাসস্থল ব্যাংকক এবং দেশের অন্যান্য অংশও কেঁপে ওঠে। নিহত ও নিখোঁজদের বেশিরভাগই রাজধানীর চাতুচাক বাজারের কাছে একটি নির্মাণাধীন বিধ্বস্ত ভবনের। শনিবার ধ্বংস্তুপ সরানোর জন্য আরও ভারী যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে।
মিয়ানমারের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা ও রাজনৈতিক সংকটের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল, যাহার ফলে ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধারকার্য ও চিকিৎসা সহায়তা ব্যাহত হচ্ছে। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরবরাহ ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করাও চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এই দুর্যোগ মোকাবিলাকে আরো কঠিন করে তুলেছে।
এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের রেশ না কাটতেই বিদ্রোহীদের ওপর হামলা চালিয়েছে দেশটির জান্তা বাহিনী। হামলায় সাতজন মারা গেছে বলে নিশ্চিত করে গণমাধ্যম বলেছে, ‘শান প্রদেশের উত্তরাঞ্চলের নাউনচোতে ভূমিকম্পের তিন ঘণ্টা পর হামলা চালানো হয়। এছাড়া থাইল্যান্ড সীমান্তেও বিমান হামলা চালিয়েছে জান্তা বাহিনী। জান্তা বাহিনীর এ হামলাকে বর্বর ও অগ্রহণযোগ্য বলে আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ। বৈশ্বিক সংস্থাটির বিশেষ প্রতিবেদক টম এনড্রস বলেন, যখন সবাই উদ্ধার কাজে ব্যস্ত ঠিক তখনই সামরিক বাহিনী বোমা ফেলছে। এটা নিঃসন্দেহে অগ্রহণযোগ্য।’
জান্তা সরকারের কঠোর সেন্সরশিপের কারণে এখন পর্যন্ত প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা সম্ভব হয়নি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলি আশঙ্কা করছেন হতাহতের সংখ্যা দশ হজার ছাড়িয়ে যেতে যেতে পারে।
ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির প্রেক্ষিতে জরুরি ভিত্তিতে ওষুধ, ত্রাণসামগ্রী, উদ্ধার এবং মেডিক্যাল সহায়তা প্রদানের জন্য বিশেষ বিমানে ৩০ মার্চ মিয়ানমারে গেছেন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর উদ্ধারকারী দল। এটা মানবিক সহায়তা।
আজকাল কোথাও কোন বড় ভূমিকম্পের সংবাদ শুনলেই আমরা আঁৎকে উঠি। কয়েকদিন ধরে দুশ্চিন্তা করি। সেমিনার হয়, আলোচনা, পর্যালোচনা শেষে ভয়ংকর সব ভবিষ্যতবাণী দেন অনেক বিশ্লেষক। এর প্রেক্ষিতে ঢাকাসহ দেশের পুরাতন ভবন ভেঙ্গে ফেলা নিয়ে কথা উঠে। ইট পাথরের দালানের বস্তিকে সমালোচনা করতে কুন্ঠিত হই না কেউই।
আবার অনেকে বাড়িঘর বাদ দিয়ে কংক্রীটের দ্বিতল রাস্তা, রেললাইন, এলিভেটেড সড়ক ইত্যাদি না বানানোর পক্ষে মতামত দিই। কারণ জাপানের কোবে শহরে একটি দ্বিতল রাস্তা উল্টে পড়ে গেলে সেটার কংক্রীট সরানো নিয়ে কালক্ষেপণ ও যে কঠিন ভোগান্তি হয়েছে সেটা বিশ্ববাসী জানে। একটি উন্নত দেশে অত্যাধুনিক ক্রেণ ও রেসকিউ সরঞ্জাম থাকার পরও হেলে পড়া দ্বিতল রাস্তার কংক্রীটের চাক কেটে কেটে ডেব্রিজ সরানোর কাজে যে বিপর্যয় তৈরী হয়েছিল তা এখন একটি করুণ ইতিহাস। সেগুলো এখনও নানা সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়। আমরা ভয়ে ভয়ে শুনি, এক অপরকে দোষারোপ করি। একসময় দোয়া পড়ি ও সান্তনা খুঁজি। ক’দিন বাদে সবকিছু ভুলে যাই। আবার আগের মতো চলতে থাকি।
সারা পৃথিবীতে নির্মাণ কাজের মহাযজ্ঞ চলছে। তেল-গ্যাস উত্তোলন, বহুতল ভবন, ব্রীজ, বাঁধ-ড্যাম, ওভারব্রীজ, দ্বিতল, ত্রিতল রাস্তা, পানি-গ্যাস ও বিদ্দুতের লাইন ইত্যাদি নির্মাণে ভূমির অতি ব্যবহার শুরু হয়েছে। এত নানা জায়গায় ভূতলের স্তরে ভাঙ্গন সূচিত হয়ে ভূত্বকে ভয়াবহ ভূমিধ্বসের শিকার হচ্ছে। মাটির নিচে সুড়ঙ্গ তৈরী করে বৃহৎ ক্যাটারপিলার দিয়ে মহা কম্পন তরঙ্গ সৃষ্টি করা হচ্ছে। স¤প্রতি ভারতের বিহার রাজ্যের যোশীমঠ শহরে শত শত ভবন, ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় উপাসনাগার, অফিস, শিক্ষাঙ্গন সহ মাটি ও পাহাড়ে বড় বড় ফাটল দেখা দেয়ায় সেখানে মানুষকে বসতি থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হয়েছে এবং জরুরী সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে (জিনিউজ ০৫.০১.২০২৩)। ধারণা করা হয়, যোশীমঠ শহর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে একটি বৃহৎ টানেল তৈরীর কম্পন থেকে এক সপ্তাহে ৫৬১টি বাড়িতে ফাটল দেখা দেয়। শহরের রাস্তা ও পাহাড়গুলোতে ফাটল তৈরী হয়।
সারা পৃথিবী যখন ভূমিকম্পের ভয়ে ছোট ছোট ঘরবাড়ি তৈরী করে ঘিঞ্জি নগরায়ণ প্রক্রিয়া থেকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধমে প্রকৃতির সান্নিধ্যে গিয়ে বসতি তৈরীকে প্রাধান্য দিচ্ছে তখন আমরা নতুন করে পাহাড় কাটছি, দেশের বড় শহরগুলোকে সুউচ্চ দালানের বস্তি এবং দ্বিতল-তৃত্বল রাস্তা, রেললাইন, এলিভেটেড সড়ক ইত্যাদি দিয়ে কংক্রীটের ফাঁদ তৈরীর মহোৎসব শুরু করেছি। এসব প্রতিযোগিতা কতটুকু ক্ষতিকর সেসম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেও অজ্ঞানতার মধ্যে দিনাতিপাত করতে চেষ্টা করছি।
মানুষ বেপরোয়ভাবে প্রকৃতির উপর হস্তক্ষেপ না করলে প্রকৃতি বার বার প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে না বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী করোনার ক্ষতিকর প্রভাব এখনও কাটেনি। এর মধ্যে ডেঙ্গু মহামারী, রাজনৈতিক একগুঁয়েমীপনা ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণহুংকারের দামামা বেজেই চলছে। এর সাথে হঠাৎ প্রলয়ংঙ্কারী ভূমিকম্পের মতো মৃত্যুর আহব্বান মেনে নেয়া খুব কষ্টকর।
তাই আমাদের দেশে ভেবেচিন্তে মহাপ্রকল্পগুলো হাতে নেয়া উচিত। এজন্য যথেষ্ট সময় নিয়ে যথার্থ (ইআইএ ও এসআইএ) মূল্যায়ণ সাপেক্ষে কাজে হাত দেয়া উচিত। কারণ শুধু পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ণই নয়- সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ণ না করলে মান্দানাও, ব্যাংককের মতো আমাদের দেশের গর্বের উঠতি বসতি, এতদিনের স্থিত কৃষ্টি ও সভ্যতার বিনাশ সাধন হওয়াটা মুহূর্তের ব্যাপার হতে পারে।
ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, যা পৃথিবীর গতিশীল প্রক্রিয়ার একটি অংশ। তবে, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, অবকাঠামোগত পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পের ইতিহাস (রিখ্টার স্কেল ৯.৫, চিলি মে, ১৯৬০) থেকে অদ্যাবধি যেসব ভূমিকম্প হয়েছে তা শুধু ধ্বংসের সাক্ষী দেয়।
ভুমিকম্প এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যার সঠিক পূর্বাভাস দেয়ার ব্যবস্থা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তাই হঠাৎ এসে হাজির হওয়া এই দুর্যোগ যে কোন সময় মৃত্যুর মুখোমুখি হবার একটি চরম বার্তা। তবে ভূমিকম্পের ঝুঁকি আছে এমন ভৌগলিক এলাকায় বসবাসকারীগণ অনেকটা সাবধানতা অবলম্বন করার মাধ্যমে এর ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কমাতে পেরেছেন বলে মনে হয়।
বাংলাদেশে আমরা সবসময় ভুমিকম্প আতঙ্কে থাকি। এ নিয়ে আমাদের করণীয় কি তা নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই। বড় বড় শহরের মানুষেরা এ নিয়ে বেশী উৎকন্ঠায় থাকেন। ভুমিকম্প প্রতিকার বা প্রতিরোধ কোনটাই করার মতো কোন সঠিক কৌশল অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয়নি। শুধু ঘটে গলে তা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য বা মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন প্রস্তুতির কথা বার বার বলা হলেও কেউ গা করেন না।
ভুমিকম্প আতঙ্কে না ভুগে যে কোন সময় তা মোকাবেলার জন্য সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে সবচেয়ে বড় দিক। নয়-দশ মাত্রা ভুমিকম্প সহনীয়তা পরীক্ষা করে ভবনের ভিত্তি দেয়া, হাতের কাছ বাঁশি, এলার্ম বা হুইসেল রাখা, শুকনো খাবার, বাসায়, অফিসে এবং স্কুলের বাচ্চাদের মাথা গোঁজার জন্য একটি উচু কাঠের টেবিল রাখা ইত্যাদিসহ ছোটখাটো কিছু কৌশল মনে রেখে ভয় না পেয়ে সেগুলো দ্রুত মানতে পারলে বড় ভূমিকম্পেও অনেক জীবন রক্ষা করা সম্ভব। তাই সময় থাকতে সাবধান না হলে পরে আফসোস করার উপায় থাকবে না।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]