বৃহস্পতিবার | ২২ মে, ২০২৫ | ৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

নিজের পা ও বাবাকে হারিয়ে অনিশ্চিত তুরাইফার জীবন

নাটোর প্রতিনিধি:
নিজের ইচ্ছে মত আর ছোটাছুটি করতে পারবে না তুরাইফা। বন্ধুদের সাথে আর দৌড়ঝাঁপ করা হবে না তার। কখনো বাবার সাথে খুনসুটি কিংবা কোন আবদার করতে পারবে না। বাবার একমাত্র রাজকন্যা জীবনের মানে বুঝে ওঠার আগেই নেমে এসেছে রাজ্যের অমানিশা। গুরুতর আহত মা এখনো বিপদমুক্ত নন।
এরমধ্যে নিজের পা হারিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বারবার বায়না ধরছে বাবার কাছে যাওয়ার। বাবার কাছে গেলেই নাকি তার পা ভালো হয়ে যাবে। বাবাকে দেখতে তার খুব ইচ্ছা করছে। অথচ ৫ বছর বয়সী শিশু উম্মে তুরাইফা এখনো জানেই না যে তার বাবা আর কখনো ফিরবেন না। গত ১৪ মে পঞ্চম জন্মদিনটি একমাত্র স্মৃতি হয়ে থাকলো বাবার সাথে তার শেষ জন্মদিন উদযাপন।
ছোট্ট শিশু তুরাইফা নাটোরের লালপুর উপজেলার দুড়দুড়িয়া ইউনিয়নের জামতলা গ্রামের জাহিদ হাসান শান্ত (২৭) ও জেসমিন খাতুন (২৩) দম্পতির একমাত্র সন্তান। গত সোমবার (১৯ মে ২০২৫) বাবা ও মায়ের সাথে স্কুলে যাওয়ার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় এলোমেলো হয়ে গেছে তুরাইফার পরিবার। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার গ্রীন হ্যাভেন স্কুলের শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থী তুরাইফা প্রতিদিনের মতো বাবার মোটরসাইকেলে স্কুলে যাওয়ার সময় ঈশ্বরদী-বানেশ্বর আঞ্চলিক মহাসড়কের বানিয়াপাড়ায় পৌছালে বাঘা থেকে ছুটে আসা ঢাকাগামী দ্রুত গতির সুপার সনি এক্সপ্রেস তাদের চাপা দেয়। এতে বাবা ও মেয়ে উভয়ের ডান পা হাটু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সঙ্গে থাকা অন্তঃসত্ত্বা মা জেসমিনের ডান হাত ভেঙে যায়। স্থানীয়রা দ্রুত উদ্ধার করে তাদের প্রথমে বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে বাবা ও মেয়ের অস্ত্রোপচার করে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়। চিকিৎসকদের পরামর্শে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু ওই দিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তুরাইফার বাবা শান্ত। তার মৃত্যুর খবরটি এখনো জানানো হয়নি স্ত্রী জেসমিন খাতুনকে। মারাত্মক আঘাতে তার (জেসমিন) হাত, কোমরের হাড় (পেলভিস) ও পিঠের হাড় (স্কাপুলা) ভেঙে গেছে। মাথায় আঘাত ও মেরুদণ্ডের কশেরুকা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। অন্তঃসত্ত্বা মাকে এখনো আশঙ্কামুক্ত বলতে পারছেন না কর্তব্যরত চিকিৎসকরা।
গর্ভে থাকা সন্তানের নেই কোনো নিশ্চয়তা। সে কি পৃথিবীর আলো দেখবে, নাকি বাবার মতো পাড়ি জমাবে পরপারে! আর পৃথিবীতে আসলেও কোনো দিন পাবে না বাবাকে। বাবার আদর, স্নেহ-ভালোবাসাও পাবে না।
মঙ্গলবার (২০ মে ২০২৫) রামিকের কর্তব্যরক্ত চিকিৎসক সার্জন, শিশু বিভাগ চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিশু তুরাইফাকে তার মায়ের পাশাপাশি অর্থোপেডিক বিভাগের এক নম্বর ওয়ার্ডে বেডে স্থানান্তর করা হয়েছে। সে কথা বলতে পারছে।
তার মা জেসমিনের কোমরের হাড় (পেলভিস), পিঠের হাড় যা হাতের সাথে যুক্ত থাকে (স্কাপুলা) ভেঙ্গে গেছে। মাথায় আঘাত আছে। পরবর্তী উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে নিউরো সার্জারী ও গাইনী বিভাগে যোগাযোগ করা হয়েছে। তবে রোগী এখন স্থিতিশীল আছে। বাচ্চাও স্থিতিশীল আছে।
এদিকে শান্তর বাবা মালয়েশিয়া প্রবাসী এজাহার আলী এ খবরে পাগলপ্রায়, হারিয়ে ফেলেছেন ভাষা। দূরদেশে শান্তনা দেওয়ার মত পাশে কেউ নেই।
আর ছেলের মৃত্যু, নাতনির পা হারানো ও ছেলের বউয়ের মুমূর্ষ অবস্থায় শান্তর মা জামিরন বেগম শোকে পাথর হয়ে গেছেন। বাক প্রতিবন্ধী বোন জোবাইদার (২২) চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। ভাই হারানোর ব্যথায় সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে আত্মীয়দের শোকের মাতম।
২০১৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য চীনে গিয়েছিলেন শান্ত। তবে স্নাতক শেষ না করেই দেশে ফিরে এসে বাড়ির পাশে জামতলা বাজারে দিয়েছিলেন হার্ডওয়ারের দোকান। স্ত্রী, সন্তান, বাবা ও মাকে নিয়ে গড়েছিলেন এক সুখের সংসার। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা নিমিষেই সব এলোমেলো করে দিয়েছে। অনিশ্চিত মেয়ে তুরাইফা, স্ত্রী জেসমিন ও তার পেটে সন্তানের ভবিষ্যত। পরিবারের এমন অবস্থায় পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় আর কোন পরিবারকে যেন এমন করুণ পরিণতি ভোগ করতে না হয়। সড়ক হোক নিরাপদ। এমনটাই চাওয়া এলাকাবাসীর।

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.