নিজস্ব প্রতিবেদক:
“বাবা, আমরা একসঙ্গে পরীক্ষা দিলে কেমন হয়?” মেয়ের এমন প্রশ্নের কোন উত্তর সেদিন তিনি দেননি। তবে মনের ভেতর লুকানো সুপ্ত ইচ্ছাটি আবার জেগে উঠেছিল নতুন করে। সেই ইচ্ছা ও স্বপ্ন পূরণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিরতির ২৬ বছর পর মেয়ের সঙ্গে এইচএসসি – ২০২৫ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সাফল্যের সঙ্গে কৃতকার্য হয়েছেন বাবা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেয়েকে পেছনে ফেলে ফলাফলেও এগিয়ে রয়েছেন তিনি। এতে স্থানীয়রা প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন তাকে।
শুরুটা হয়েছিল ২০২৩ সালে। মেয়ের এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন চলছে সেই খোঁজখবর নিতেন নিয়মিত। মাঝে মাঝে পাঠ্য বিষয়ের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও পরামর্শ দিতেন মেয়েকে। সে সময় বাবাকে নিজের সঙ্গে পরীক্ষা দেয়ার জন্য বলেছিলেন মেয়ে মোছা. হালিমা খাতুন। তখন মুখে কিছু না বললেও কাউকে না জানিয়ে উপজেলার রুইগাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন চা বিক্রেতা বাবা মোঃ আব্দুল হান্নান। গোপালপুর পৌর এলাকার নারায়ণপুর গ্রামের মৃত লাল মিয়ার ছেলে আব্দুল হান্নান মেয়েকে পড়া দেখানোর ফাঁকে নিজের জন্য নিয়ে ফেলেছিলেন পূর্ণ প্রস্তুতি। পরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিরতির দুই যুগ পর এসএসসি – ২০২৩ পরীক্ষায় মেয়ের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। এ বছর এইচএসসি – ২০২৫ পরীক্ষায় মেয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন গোপালপুর ডিগ্রী কলেজ থেকে ও বাবা অংশগ্রহণ করেছিলেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার কাকড়ামারী কলেজ থেকে। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এইচএসসি – ২০২৫ পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় মেয়ে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৩.৭১ ও বাবা কারিগরি শাখা থেকে জিপিএ ৪.৩৩ অর্জন করেছেন। বাবা-মেয়ের এমন সাফল্যের কথা উপজেলার প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।
রবিবার কথা হয় বাবা ও মেয়ের সঙ্গে। বাবা আব্দুল হান্নান বলেন, আমি এসএসসি – ১৯৯৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলাম। ১৯৯৮ সালে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস হাই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রাক নির্বাচনী (টেস্ট) পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলাম। ফলে স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে এসএসসি-১৯৯৯ পরীক্ষায় অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়নি। পরে দারিদ্রতা ও সংসারের চাপে আর পড়াশোনা করা হয়নি। সেই থেকে গোপালপুর বাজারে আমার একটি চায়ের দোকান চালাতাম। মেয়েকে মাঝে মাঝে পড়াশোনার বিষয়ে পরামর্শ দিতাম। একদিন মেয়ে হঠাৎ করে বলে উঠলো বাবা আমরা একসঙ্গে পরীক্ষা দিলে কেমন হয়? সেই থেকে শুরু হলো বাবা মেয়ের পথ চলা। শিক্ষা বিরতির ২৬ বছর পর এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভালো লাগছে।
মেয়ে হালিমা খাতুন জানান, এসএসসিতে বাবার সাফল্য আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। এখন বিএসসি ইন নার্সিং কোর্সে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা আছে। ভবিষ্যতে সে নার্স হয়ে অসুস্থ মানুষের সেবা করতে চায়।
অন্যদিকে বাবা আব্দুল হান্নান দেখছেন এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার স্বপ্ন। বর্তমানে কৃষি কাজ করেন তিনি। অবসরে গান ও কবিতা লিখা তার অন্যতম শখ। গান লিখে নিজেই সুর করেন। সেই গান গেয়ে আপলোড করেন নিজের ইউটিউব চ্যানেলে। তিনি স্বপ্ন দেখেন তার গান ও কবিতাগুলো একদিন জনপ্রিয়তা পাবে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও মাজার শরীফ বিএমটি উইমেন্স কলেজের অধ্যক্ষ ইমাম হাসান মুক্তি বলেন, আব্দুল হান্নান সমাজের অনুপ্রেরণা। তিনি প্রমাণ করেছেন, শেখার কোন বয়স নেই।
তার এমন সাফল্যে অভিনন্দন জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, বাবা মেয়ের এমন সাফল্য অন্যদের অনুপ্রাণিত করবে।
সম্পাদনায়: রাশিদুল ইসলাম রাশেদ
সাব এডিটর, প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ