-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
সম্প্রতি উত্তর বাংলাদেশের পাঁচ জেলার মানুষ তিস্তা তীরবর্তী এলাকায় একসংগে ১০৫ কিলোমিটার জুড়ে মশাল প্রজ্বলন করেছেন। রংপুর বিভাগের লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার তিস্তা তীরবর্তী ১১টি পয়েন্টে একযোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে এই প্রতীকী কর্মসূচি। তারা চীনের সহায়তায় তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন চেয়ে এই দাবী তুলেছেন। তিস্তাপানির ন্যয্য হিস্যার দাবীতে সেই সন্ধ্যায় উত্তাল হয়ে উঠেছিল গোটা তিস্তা পাড়। মশাল প্রজ্জ্বলন কর্মসূচিতে অংশ নেন রংপুর বিভাগের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, ছাত্র ও যুবসমাজের নেতাকর্মীরা। তাঁদের স্লোগান ছিল, জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাও, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দাও। তবে মশালের আলোয় তিস্তা পাড় প্রজ্জলিত হয়ে উঠলেও ফলোআপ করে খেয়াল রাখতে হবে এই আলো আসলে কতদূরে কার কার কাছে পৌঁছাবে?
ঢাকার নীতিনির্ধারণের কক্ষে কি এই আলো পড়বে? দিল্লিতে বা বেইজিংয়েও দ্রুত পৌছুতে হবে? নয়তো কেবল মিডিয়ার ক্যামেরায় বন্দী হয়ে আবারও নিভে যাবে প্রতিবাদের শিখা? কারণ, তিস্তা নিয়ে আলোচনার ইতিহাসও প্রায় চার দশকের পুরোনো। ১৯৮৩ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টন আলোচনা শুরু হয়, কিন্তু তা কখনো চুক্তিতে রূপ নেয়নি। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় চুক্তির খসড়া প্রায় প্রস্তুত হলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে তা ভেস্তে যায়। এরপর থেকে বাংলাদেশের তিস্তাসংকট যেন রাজনৈতিক সৌজন্যের আড়ালে বন্দী এক অনন্ত প্রতীক্ষা।
তবে প্রযুক্তির কল্যাণে এই মশালের আলো এখন পর্যন্ত কতদূর পৌঁছাল তা এখনও জানা যায়নি। এছাড়া কয়েকমাস পূর্বে তিস্তা পাড়ে গণপদযাত্রা কর্মসূচি পালন করা হয়েছিল। সেটার ফলোআপ কি হলো তাও পরবর্তীতে জানা যায়নি।
তিস্তা একটি বহুল পরিচিত নদীর নাম। অথচ উত্তর বাংলাদেশের পাঁচ জেলার মানুষের কাছে এটি আজ জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা এক আর্তনাদ। একসময় তিস্তা ছিল কৃষকের প্রাণ, মৎস্যজীবীর ভরসা, প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতীক। একসময় তিস্তা ছিল জীবনের দোলনা, কৃষির প্রাণ, গানের উৎস। আজ তা শুকনো বালুচরে পরিণত, যার বুক ফুঁড়ে চলছে বালু ব্যবসা, আর পাশে দাঁড়িয়ে মলিন চোখে তাকিয়ে আছে নদীভাঙনে সর্বস্ব হারানো মানুষ। এখন সে শুকনো বালুচর, ভাঙনের গহ্বর আর দারিদ্র্যের প্রতিচ্ছবি।
সেই বাস্তবতায় সম্প্রতি ১০৫ কিলোমিটারজুড়ে মশাল প্রজ্বলন শুধু একটি প্রতীকী প্রতিবাদ, এটি তিস্তা পাড়ের মানুষের অনেক আশার প্রতিধ্বনি। তারা বলছে, চীনের তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করো। কারণ এই প্রকল্পেই তারা দেখছে মুক্তির সম্ভাবনা, জীবনের পুনর্জাগরণ।
বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থার মধ্যে তিস্তা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের কৃষি, পরিবেশ ও জনজীবনের জন্য। কিন্তু ভারতের উজানে অসংখ্য ব্যারাজ, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বাঁধের কারণে এর পানি প্রবাহ এখন অতীতের ছায়া। শুষ্ক মৌসুমে নদী প্রায় শুকিয়ে যায়, বর্ষায় আবার হঠাৎ বন্যা। এই অস্বাভাবিক পরিবর্তনে কৃষক হারাচ্ছে ফসল, নদীভাঙনে মানুষ হারাচ্ছে ঘরবাড়ি, কর্মসংস্থান হারিয়ে তরুণরা পাড়ি দিচ্ছে শহরে। যে নদী একসময় জীবন দিয়েছে, আজ সেই নদীই দিচ্ছে বঞ্চনা।
এই বাস্তবতা থেকেই তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্পের ধারণা। ২০২০ সালে চীন প্রস্তাব দেয় প্রায় ১০০ কোটি ডলারের একটি প্রকল্প, যার আওতায় তিস্তার দুই পাড়ে আধুনিক নদীশাসন, পানি সংরক্ষণ, সেচব্যবস্থা উন্নয়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ সংরক্ষণের পরিকল্পনা ছিল। এতে তিস্তা ব্যারাজ আধুনিকীকরণ, ড্রেজিং, নদী গভীরীকরণ এবং পানি সংরক্ষণের জন্য একাধিক রিজার্ভার নির্মাণের কথাও ছিল। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তিস্তা অববাহিকার প্রায় ৭ লাখ হেক্টর জমি সেচ সুবিধা পাবে, ১ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা বদলে যেতে পারে।
কিন্তু বাস্তবে প্রকল্পটি এখনো আলোচনার টেবিলে বন্দী। চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সমঝোতা এখনো হয়নি; অন্যদিকে ভারতের কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকল্পটি কৌশলগত সংবেদনশীলতার কারণে জটিল আকার নিচ্ছে। ভারতের আশঙ্কা তিস্তা অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি তাদের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। অথচ বাস্তবতা হলো, ভারত নিজেই তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে এক যুগ ধরে অনীহা দেখিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের আপত্তির কারণে ২০১১ সালের ঐতিহাসিক তিস্তা চুক্তিও ভেস্তে যায়। ফলে বাংলাদেশ আজ দাঁড়িয়ে আছে এক অচলাবস্থায় না পাচ্ছে ন্যায্য পানি, না পাচ্ছে বিকল্প প্রকল্পের সুফল।
এই প্রেক্ষাপটে তিস্তা পাড়ের মানুষের মশাল প্রজ্বলন করে দাবি তুলেছে আমাদের জীবন বাঁচার অধিকার ফিরিয়ে দাও। তারা ১০৫ কিলোমিটারজুড়ে হাজারো মানুষ হাতে মশাল নিয়ে যখন নদীর তীরে দাঁড়াল, তখন তা যেন অন্ধকারে আলো খোঁজার প্রতীক হয়ে উঠল। তাদের চোখে আশা চীনের সহায়তায় হয়তো আবারও তিস্তা বয়ে যাবে, কৃষিজমি সবুজ হবে, কাজের সুযোগ তৈরি হবে, নদীভাঙনের ভয় কমবে।
ঢাকার প্রশাসনিক কক্ষ থেকে শুরু করে দিল্লির নীতিনির্ধারক কিংবা বেইজিংয়ের পরিকল্পনাবিদ তারা কি এই আলো দেখতে পেয়েছেন? নাকি প্রতিবাদের আগুন নিভে গেছে আলো ছড়ানোর আগেই? সত্য হলো, তিস্তা এখন শুধুই পরিবেশগত সংকট নয়, এটি হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যের প্রতীক। বাংলাদেশকে তাই এখন বাস্তববাদী কৌশল নিতে হবে। একদিকে চীনের প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে এগোতে হবে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নদীরক্ষাসহ উত্তরবঙ্গের অর্থনীতি, কৃষি ও সমাজব্যবস্থা নতুন প্রাণ পেতে পারে। কিন্তু এজন্য প্রয়োজন কার্যকর কূটনীতি, দ্রুত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ। বাংলাদেশে রাজধানী বা বড় বড় শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন যেন বিদেশি বিনিয়োগের প্রদর্শনীতে পরিণত না হয়ে তা যেন হয় স্থানীয় জীবনের পুনর্গঠনের হাতিয়ার।
তিস্তা পাড়ের লাখো মানুষ সে রাতে প্রশ্ন রেখেছে, আমাদের নদী কি আবার স্বাভাবিক কল কল রবে বয়ে যাবে? নাকি বার বার ভারতের কৃত্রিম বন্যার শিকার হতেই থাকবে? সরকারের উচিত এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা কর্মে, নীতিতে ও সাহসে। কেবল প্রতিশ্রুতি বা ফটোসেশনে তিস্তা ফিরবে না, ফিরবে পরিকল্পিত প্রকল্প, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও স্থানীয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এজন্য আজ প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কূটনৈতিক দক্ষতা এবং জনগণের ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর। ১০৫ কিলোমিটার জুড়ে প্রজ্বলিত মশাল যেন কারো অবহেলায় অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। তা হোক তিস্তা অববাহিকার নতুন সকালের বার্তা।
এজন্য ১৭ জুলাই ২০২৫ জুলাই সনদ স্বাক্ষর হওয়া নতুন বাংলাদেশের সরকারের উচিত ভারতের সঙ্গে নতুন করে তিস্তা চুক্তি আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া এবং কূটনৈতিক চাপের পাশাপাশি বিকল্প ব্যবস্থাও খোঁজা। যেমন, তিস্তা ব্যারাজ আধুনিকীকরণ, অভ্যন্তরীণ খাল-নদী সংযোগ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, এমনকি চীনের প্রস্তাবিত তিস্তা পুনুরুজ্জীবন প্রকল্প নিয়ে বাস্তবসম্মত ও জাতীয় স্বার্থনির্ভর মূল্যায়ন করা।
একই সঙ্গে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণমূলক উদ্যোগের গুরুত্বও অনস্বীকার্য। পরিবেশবাদী সংগঠন, কৃষক সমিতি, যুবসমাজ সবাইকে এই লড়াইয়ের অংশীদার করতে হবে। কারণ নদী রক্ষা কোনো সরকারের একক দায়িত্ব নয়, এটি একটি সামাজিক আন্দোলন। তিস্তার প্রবাহ যদি স্থায়ীভাবে রক্ষা করা যায় তাহলে শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, পুরো দেশের খাদ্যনিরাপত্তা, পরিবেশগত ভারসাম্য ও আঞ্চলিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।
অতএব তিস্তা তীরে জ্বলা এই মশালবাহীদের কন্ঠধ্বনি, প্রাণের দাবী যথাযথ জায়গায় ছড়িয়ে পড়ুক। আমাদের রাষ্ট্র যদি এই আহ্বান শুনতে পায় তবে এই মশালের আলো পৌঁছাবে ঢাকায়, দিল্লিতে, বেইজিংয়েও। আর এই মশালের আলো এবার সত্যিই দূরপ্রাচ্য পর্যন্ত পৌঁছে তিস্তা পানি সমস্যার একটা টেকসই সমাধান তৈরী করতে পারবে।
× প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]