
রাশিদুল ইসলাম রাশেদ :
নাটোরের লালপুরে সেচ প্রকল্পে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ফলে গ্রাহকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে চুরির আতঙ্ক। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ও লালপুর থানা সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় মাসে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৩০টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে, যার বাজারমূল্য ২১ লাখ টাকার বেশি। সম্প্রতি চোর চক্রের দৌরাত্ম্যে শুধু গত ১০ দিনেই উপজেলায় ৯টি ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনা ঘটেছে। ফলে সেচ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।
স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন, লাগাতার এসব চুরির ঘটনায় তারা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। চুরি রোধে উদ্যোগ না নিলে আগামী মৌসুমে সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
কেশববাড়িয়া গ্রামের নঈমুউদ্দিন প্রামানিকের ছেলে কৃষক সাইদুর রহমান (৫৫) বলেন, “চারপাশে ট্রান্সফরমার চুরি হচ্ছে শুনে পাহারা বসিয়েছিলাম। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। গত শনিবার (২৫ অক্টোবর) রাতে আমার নলকূপের তিনটি ট্রান্সফরমারের সব যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে গেছে চোরেরা।”
এর আগে ২৪ অক্টোবর দুড়দুড়িয়া ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামের গোলাম আযম (৫২), ১০ অক্টোবর ঢুষপাড়া গ্রাম থেকে লালপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দিক পলাশ (৫৫), ৭ সেপ্টেম্বর রামানন্দপুর (গোবরপুর) গ্রাম থেকে লালপুর কলেজের সাবেক শিক্ষক মো. শফিউল্লাহ ও ছোট বিলশলিয়া গ্রামের শহিদুল ইসলাম এর ছেলে বাকিব উদ্দিনের (৪৫) গভীর নলকূপ থেকে ট্রান্সফরমার চুরি হয়। এছাড়া গত জুলাই ও আগস্ট মাসে আরও নয়টি ট্রান্সফরমার চুরির তথ্য পাওয়া গেছে।
আড়বাব ইউনিয়নের কচুয়া গ্রামের নাজমুল হক জানান, “আমার দুই দফায় মোট পাঁচটি ট্রান্সফরমার চুরি গেছে। প্রতিটি ট্রান্সফরমার নতুন করে কিনতে বিএমডিএ অফিসে ৭০ হাজার টাকা ও নাটোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ অফিসে পরীক্ষার জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা দিতে হয়েছে। নতুন ট্রান্সফরমার কিনে কেন আবার গ্রাহকের টাকায় পরীক্ষার নামে হয়রানি করা হচ্ছে জানি না।”
রামানন্দপুর গ্রামের সাবেক শিক্ষক মো. শফিউল্লাহ বলেন, “চুরি ঠেকাতে ট্রান্সফরমারের গায়ে দোয়া লিখেছিলাম যাতে চোরেরা আল্লাহর ভয়ে চুরি না করে, খুঁটির উঠার ফাঁকা জায়গা বন্ধ করে দিয়েছিলাম, কাটা তারের বেষ্টনী দিয়েছিলাম, তবুও কিছুই কাজে আসেনি। ৭ সেপ্টেম্বর রাতে আমার নলকূপের দুটি ট্রান্সফরমার চুরি হয়। এর বাজারমূল্য প্রায় দুই লাখ টাকা।”
উধনপাড়া গ্রামের আনিসুর রহমান (৪৪) বিএডিসির অধীনে একটি গভীর নলকূপ পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, “চারদিকে চুরির ঘটনায় আমরা আতঙ্কে আছি। কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আগামী মৌসুমে সেচ প্রকল্প চালানোই কঠিন হয়ে পড়বে।”
গ্রাহকরা অভিযোগ করে বলেন, পল্লী বিদ্যুতের নিজস্ব ট্রান্সফরমারগুলো সাধারণত চুরি হয় না। বেছে বেছে সেচ প্রকল্পে ব্যবহৃত ব্যক্তি মালিকানাধীন ট্রান্সফরমার গুলো চুরি করা হচ্ছে। এক্সপার্ট ছাড়া এ সকল ট্রান্সফরমার চুরি করা সম্ভব নয়। চোর সিন্ডিকেটের সাথে পল্লী বিদ্যুৎ ও প্রশাসনের যোগসাজশ থাকতে পারে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে নাটোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২, লালপুর জোনাল অফিসের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মো. রেজাউল করিম বলেন, “একটি সংঘবদ্ধ চক্র পরিকল্পিতভাবে এসব চুরি করছে। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। গ্রাহকদের সতর্ক থাকার অনুরোধ করছি।”
এ বিষয়ে বিএমডিএ বড়াইগ্রাম জোনের উপ সহকারী প্রকৌশলী মো. আবুল বাশার বলেন, আমরা সব সময় কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা করি। আমরা বুয়েট থেকে টেস্ট করে ট্রান্সফরমার ক্রয় করি। কিন্তু পল্লী বিদ্যুতের নিয়মের বেড়াজালে আমাদের পুনরায় ট্রান্সফরমার পরীক্ষা করাতে হয়। আর নিয়ম অনুযায়ী ট্রান্সফরমারগুলো গ্রাহকদের নিজ দায়িত্বে সংরক্ষণ করতে হবে। চুরির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
ট্রান্সফরমার চুরির বিষয়ে বিএডিসি বড়াইগ্রাম জোনের সহকারী প্রকৌশলী ও লালপুর উপজেলা সেচ কমিটির সদস্য সচিব মো. জিয়াউল হক বলেন, কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় আমরা সব সময় কাজ করে যাচ্ছি। সেচ প্রকল্পে ব্যবহৃত ট্রান্সফরমার চুরির বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। লালপুর উপজেলায় বিএডিসি- এর আওতায় চারটি গভীর নলকূপ আছে। এখন পর্যন্ত সেখানে কোন ট্রান্সফরমার চুরি হয়নি। তবে বড়াইগ্রাম উপজেলায় আমাদের অনেকগুলো ট্রান্সফরমার ইতিমধ্যে চুরি হয়ে গেছে। গ্রাহকদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে আমরা সব রকমের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনায় থানায় কয়েকটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। চুরি যাওয়া মালামাল উদ্ধার ও চোর চক্রকে গ্রেফতারে পুলিশের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
স্থানীয়দের মতে, চুরি রোধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নিলে আসন্ন মৌসুমে সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হবে এবং কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।