শনিবার | ১ নভেম্বর, ২০২৫ | ১৬ কার্তিক, ১৪৩২

শিশির ভেজা ঘাসে শীতের আগমনী বারতা, খেজুর রসে জেগে উঠেছে জনপদ

নাটোর প্রতিনিধি :

শিশির ঝরা ঘাসে ভোরের আলো ফোটে, হিমেল হাওয়ার মলয় ছুঁয়ে যায় প্রকৃতিকে। কবি সৌম্যকান্তি চক্রবর্তীর ভাষায়— “হেমন্ত এসে গেছে, শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে”। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে এখন রূপে, গন্ধে ও অনুভবে অনন্য এক সময় হেমন্তকাল। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত শীতল বাতাসে ভেসে আসে কুয়াশার চাদর। প্রত্যুষে ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দুর মাঝে লুকিয়ে থাকা প্রভাতের প্রকাণ্ড সূর্য। চারদিকে পাতা ঝরার মৃদু শব্দ, মাঠে সোনালি ধানের তরঙ্গ, উত্তরের হাওয়ায় ঢেউ খেলানো প্রকৃতি—সব মিলিয়ে শীতের আগমনী শুভেচ্ছায় বিভোর বনলতার জনপদ।
প্রকৃতির এই লীলাভূমিতে নাটোরে শীতের আগমনী হাওয়া বইছে একটু আগেই। পদ্মা, বড়াল, চন্দ্রা ও নারদের তীর ঘেঁষে থাকা এই জনপদে এখন এক ভিন্ন কর্মচাঞ্চল্য। শীতের বারতা আসার সঙ্গে সঙ্গে গাছিদের মধ্যে শুরু হয়েছে মধুবৃক্ষ খেজুরের রস সংগ্রহের তোড়জোড়। সকালে শিশিরভেজা ঘাস মাড়িয়ে তারা উঠে পড়ছেন খেজুরগাছে—কারও হাতে দা, কারও কাঁধে কলস; চলছে রস আহরণের মহাযজ্ঞ।
সম্প্রতি জেলার লালপুর, নলডাঙা, সিংড়া, বড়াইগ্রামের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে—গাছিরা ব্যস্ত গাছ পরিষ্কার ও কাঁটাযুক্ত ডাল ছেঁটে নতুন কাঠের সাদা অংশ বের করতে। কেউ কেউ ইতিমধ্যেই রস সংগ্রহ শুরু করেছেন। সেই রসের গন্ধে মৌমাছিরাও গুনগুনিয়ে সঙ্গ দিচ্ছে তাদের।
রহিমপুর গ্রামের গাছি মিঠুন আলী (৪০) বলেন, “প্রতিদিন প্রায় ৬০ থেকে ৬৫টি গাছের রস সংগ্রহ করি। পুরো মৌসুমে (তিন মাসে) প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে ২০-২৫ কেজি গুড় পাওয়া যায়।”
জয়কৃষ্টপুর গ্রামের প্রবীণ গাছি তফের মণ্ডল (৫৫) জানান, “চল্লিশ বছর ধরে রস সংগ্রহ করছি। এবারও ২০০ খেজুরগাছ প্রস্তুত করেছি। সপ্তাহখানেক হলো রস নামতে শুরু করেছে। এখন প্রতিদিন প্রায় ২০ কেজি গুড় উৎপাদন হচ্ছে।”

আর মোহরকয়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম (৫০) বলেন, “এ সময় গাছ প্রস্তুত করি। এখন বিশেষ কৌশলে কাটা অংশে রস নামছে। তবে পৌষ মাস থেকে পূর্ণমাত্রায় রস পাওয়া যাবে।”

ঈশ্বরদী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা গেছে, এ বছর লালপুরে গরমের আধিক্য ছিল আগের বছরগুলোর চাইতে বেশি। বৃষ্টিপাতের পরিমাণও ছিল যথেষ্ট। মে-জুন মাসে লালপুরে ৩৬ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠানামা করেছে। প্রায় প্রতিদিন বয়ে গেছে গরম বাতাস। গত আগস্টে ২৮১ দশমিক ৭ ও সেপ্টেম্বরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৩০০ দশমিক ২ মিলিমিটার।
আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ইনচার্জ নাজমুল হক রঞ্জন বলেন, কয়েক মাসজুড়ে গরম-বৃষ্টির পর কয়েকদিন থেকে ভোরের কুয়াশা জানান দিচ্ছে, এ মৌসুমের শীত আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেছে।
মাজার শরীফ বিজনেস ম্যানেজমেন্ট টেকনিক্যাল উইমেন্স কলেজের অধ্যক্ষ ইমাম হাসান মুক্তি জানান, “শীত এলে লালপুরের বাজারে বিক্রি হয় খেজুরের পাটালি গুড়—যার খ্যাতি সারা দেশে। রাজশাহী, ঢাকা, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, খুলনা, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হয় এখানকার গুড়। অবহেলায় বেড়ে ওঠা খেজুরগাছ এখন অর্থনীতির অংশ হয়ে উঠেছে। গাছ ঝোড়া ও রস সংগ্রহকে ঘিরে জনপদে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।”
এ বছর লালপুরে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫৮০টি খেজুরগাছের রস থেকে ২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে উপজেলা কৃষি বিভাগ। কৃষি কর্মকর্তা প্রীতম কুমার হোড় বলেন, “রেললাইনের ধারে, ক্ষেতের আইলে ও পতিত জমিতে বেড়ে ওঠা খেজুরগাছ শুধু ঐতিহ্য নয়, লালপুরের অর্থনীতিরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। শীতের মৌসুমে প্রায় দুই হাজার পরিবার এই খেজুরগাছকেন্দ্রিক কাজের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেন।”
তিনি আরও জানান, খেজুর রসে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গাছিদের রস সংগ্রহের পাত্র ঢেকে রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি অসাধু ব্যবসায়ীদের ভেজাল গুড় উৎপাদন রোধে জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে কৃষি বিভাগ।
এভাবেই শীতের প্রথম প্রহরে শিশির ভেজা মাঠে খেজুরপাতার ফাঁক গলে যখন রস টপটপ করে পড়ে কলসে, তখন নাটোরের মাটিতে ধরা দেয় এক সোনালি ঋতুর গন্ধ—যার নাম শীত।

সম্পাদনায় : রাশিদুল ইসলাম রাশেদ

সাব এডিটর, প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.