সোমবার | ৩ নভেম্বর, ২০২৫ | ১৮ কার্তিক, ১৪৩২

ঘোড়ার গাড়িতে শিক্ষকের রাজকীয় বিদায়, বই পড়ে কাটাবেন অবসর সময়

নাটোর প্রতিনিধি :

বিদায় সব সময়ই বেদনার, তবে কখনো কখনো তা হয়ে ওঠে চিরস্মরণীয়। তেমনি এক ব্যতিক্রমী ও আবেগঘন বিদায়ের আয়োজন করা হয় নাটোরের বাগাতিপাড়া সরকারি পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (টেকনিক্যাল) দিলীপ কুমার সরকারের জন্য।
দীর্ঘ ২৭ বছরের শিক্ষকতা জীবনের ইতি টেনে তিনি অবসরে গেছেন। এ উপলক্ষে রোববার (২ নভেম্বর) সকালে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সহকর্মী শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় এক বর্ণাঢ্য বিদায় সংবর্ধনা।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বিদ্যালয়ের হলরুমে প্রধান শিক্ষক মো. খালিদ হোসেন লিটনের সভাপতিত্বে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা বিদায়ী শিক্ষককে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান এবং বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ক্রেস্ট ও উপহার সামগ্রী তুলে দেন। বক্তব্য রাখেন শিক্ষক টিপু সুলতান, জয়নুল আবেদীন ও কর্মচারী রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
পরে ফুল ও বেলুন দিয়ে সাজানো ঘোড়ারগাড়িতে চড়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন দিলীপ কুমার সরকার। গাড়িতে শিক্ষকের বসার জন্য রাখা হয় সোফা, গলায় পরানো হয় তাজা গাঁদা ফুলের মালা। বিদ্যালয় থেকে তার বাড়ি লালপুরের চংধুপইল পর্যন্ত ঘোড়ারগাড়িতে করে পৌঁছে দেওয়া হয় এই প্রিয় শিক্ষককে। এ সময় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়কের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে তাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে বিদায় জানানোর দৃশ্য ছিল অত্যন্ত আবেগঘন।
প্রধান শিক্ষক খালিদ হোসেন লিটন বলেন, “বিদায়ের কষ্ট লাঘবের পাশাপাশি শিক্ষক হিসেবে তার অবদানের যথাযোগ্য সম্মান জানাতেই এমন ব্যতিক্রমী আয়োজন করা হয়েছে।”
শিক্ষক গোলাম ফারুক পিন্টু বলেন, “শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা তুলে ধরতে ও প্রিয় শিক্ষককে স্মরণীয়ভাবে বিদায় দিতে আমরা তাকে রাজকীয় সাজে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছি।”
বিদায়ী শিক্ষক দিলীপ কুমার সরকার আবেগভরে বলেন, “এই বিদ্যালয় আমার দ্বিতীয় পরিবার। সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। বিদায়ের দিন তাদের এমন ভালোবাসা আমাকে গভীরভাবে ছুঁয়ে গেছে।”
বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, তিনি ১৯৯৬ সালের ২ মে ট্রেড ইন্সট্রাক্টর (বিল্ডিং অ্যান্ড মেইনটেনেন্স) হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০২৫ সালের ৩০ অক্টোবর অবসর গ্রহণ করেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি দায়িত্ববোধ, পরিশ্রম ও শিক্ষার্থীদের প্রতি মমতায় সবার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন।
দিলীপ কুমার সরকার নাটোরের লালপুর উপজেলার চংধুপইল গ্রামের স্বর্গীয় প্রবোধ কুমার সরকারের মেজ ছেলে। তার বাবা শোভ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। পারিবারিকভাবে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত এই পরিবারে শিক্ষার প্রতি রয়েছে গভীর অনুরাগ।
তিনি চংধুপইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে করিমপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৮৫ সালে আব্দুলপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৯১ সালে রাজশাহী সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে সিভিল ইন ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই সন্তানের জনক। বড় ছেলে দিব্য কুমার সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী এবং ছোট ছেলে দেবাঞ্জন কুমার সরকার ঢাকা কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। স্ত্রী একজন গৃহিণী। অবসর-পরবর্তী সময়ে তিনি স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতেই থাকতে চান। বই পড়া তার প্রিয় শখ। পাশাপাশি তিনি কৃষিকাজের সঙ্গেও যুক্ত থাকতে চান।
দিলীপ কুমার সরকার বলেন, “এখন বই পড়া, গাছ লাগানো আর গ্রামের মানুষের সঙ্গে সময় কাটিয়েই জীবনটা কাটাতে চাই। সবার দোয়া চাই, যেন সুন্দরভাবে জীবনের বাকি সময়টা অতিবাহিত করতে পারি।”

স্থানীয়দের মতে, শিক্ষাক্ষেত্রে দিলীপ কুমার সরকারের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে, আর তার ঘোড়ারগাড়িতে রাজকীয় বিদায় বাগাতিপাড়া এলাকায় এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.