
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
সম্প্রতি দশদিন ধরে দেশের হাজারো বেসরকারী স্কুল ও কলেজ শিক্ষক রাস্তায় আন্দোলন করেছেন। তারপর এবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষকগণও রাস্তায় নেমেছেন। তাঁদের কারো দাবি ছিল ন্যায্য চিকিৎসা ভাতা, বাড়িভাড়া পাওয়া। আবার কারো দাবী জীবনধারণের উপযুক্ত বেতন বা আর্থিক সম্মান এবং অবসরে নিরাপত্তা। এ আন্দোলন কেবল কিছু দাবিদাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জানান দিয়েছে আরো অনেক কিছু। তার মধ্যে একটি হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষার প্রতি রাষ্ট্রের অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি কেমন।
বর্তমানে দেশের কর্ণধার প্রধান উপদেষ্টা, শিক্ষা উপদেষ্টা, আইন, পরিকল্পনা, ধর্ম সকলেই এককজন খ্যাতিমান শিক্ষক। এই সুবর্ণ সময়ে স্কুলের শিক্ষকগণ সামান্য বাড়ীভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধির দাবীতে দশদিন ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে, চিৎকার, কান্নাকাটি করে নিজেদের আঁকুতি করেছেন। কিন্তৃ মোট দশদিন পর্যন্ত কারো কোন বিকার লক্ষ্য করা যায়নি। সেটিই জাতিকে আজ নতুন করে ভাবতে গভীর চিন্তার খোরাক যোগাচ্ছে!
আজ এটি এক চরম বাস্তবতা। এটি আমাদের জাতীয় আত্মসম্মানের এক লজ্জাজনক প্রতিফলন। কারণ শিক্ষককে যখন রাস্তায় বসতে হয়, তখন বোঝা যায় রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার তালিকায় জ্ঞানের স্থান কতটা নিচে নেমে গেছে। সরকার প্রায়ই বলে শিক্ষার উন্নয়ন হচ্ছে, শিক্ষকদের অবস্থাও বদলাচ্ছে। কিন্তু রাস্তায় বসে থাকা হাজারো শিক্ষক প্রমাণ করেছেন আমাদের বাস্তবতা ভিন্ন।
ছোটকালে স্কুলে ভাবসম্প্রসারণ লিখেছি যে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। এই উপাধিটি আমরা শিক্ষক সমাজকে দিয়েছি একসময় সম্মানের প্রতীক হিসেবে। কিন্তু আজ সেই মেরুদণ্ডটি কেবল ব্যাথার কারণে ব্যথিত নয়। সেটা শিরদাঁড়া পর্যন্ত কোঁকড়ানো হয়ে পড়েছে সরকারের ক্রমাগত অবহেলা, উপেক্ষা আর অপ্রতুল আর্থিক সম্মানের ভারে।
এই ইতিবাচক সময়ে শিক্ষকেরা এতদিন ধরে কেন রাস্তায় থাকলেন? শ্রেণিকক্ষে যাঁরা পাঠদান করেন, চরিত্র গঠন করেন, জাতির ভবিষ্যৎ তৈরি করেন, তাঁদেরকে কেন রাস্তায় বসতে হয়? প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক, কলেজ থেকে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব স্তরের শিক্ষকই এখন একই কণ্ঠে বলেছেন, আমরা বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। বিশেষ করে বেসরকারী স্কুলের শিক্ষকগণ এই দাবীতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে সেটাই জানান দিয়েছেন জাতিকে।
বেসরকারি শিক্ষকগণ সমন্বিত বেতন কাঠামোর দাবি তুলেছেন, তাঁরা ন্যূনতম জীবিকা নিশ্চিত করার দাবিতে রাস্তায় বসেছেন। কেউ বৃষ্টিতে ভিজেছেন, কেউ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেছেন। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দরজা তখনো বন্ধ এখনো একপ্রকার বন্ধ একশ্রেণির ধান্ধাবাজ চাকুরেদের কারণে। তাই নীতিনির্ধারকদের মুখে কেবল আশ্বাসের শব্দ, যৎসামান্য প্রতিশ্রুতির প্রতিধ্বনি।সাড়ে সাত শতাংশ ভাতাবৃদ্ধির ঘোষণা আপাতত: মন্দের ভাল হিসেবে কাজ করতে পারে। কিন্তু এদিয়ে শিক্ষকদের অর্থের অপ্রতুলতা কি বাজার দরের সাথে কখনও সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে?
অপ্রতুল বেতনের অঙ্কে ভেঙে যাওয়া সম্মান নিয়ে আমাদের শিক্ষকদের দিনাপাত চলে বড় কায়ক্লেষে। বাংলাদেশে সরকারি স্কুলের নতুন শিক্ষক মাসে পান ১৮,০০০–২০,০০০ টাকা, আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেকের বেতন ১০,০০০ টাকারও কম। এই আয়ে সংসার চালানো মানে প্রতিদিন মর্যাদা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্বে হারতে থাকা এক জীবন। যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রতিদিন বাড়ছে, সেখানে শিক্ষকরা বেঁচে আছেন বেতনের কষ্টিপাথরে। বহু শিক্ষক অতিরিক্ত টিউশন বা কোচিং করে সংসার চালান। লজ্জাস্কর। কিন্তু এটাই তো আসল ট্র্যাজেডি যে, শিক্ষককে বাঁচতে হলে শিক্ষা বিক্রি করতে হয়!
কিন্তু তাতে শিক্ষকতার মূল মর্যাদাই দিন দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে। এছাড়া শিক্ষককে যখন জীবিকা রক্ষায় শিক্ষাকে পণ্য বানাতে হয়, তখন বুঝতে হবে এত করে করে একটি জাতির মেরুদণ্ড সত্যিই কোঁকড়ানো হয়ে গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য এই বেতন ভাতার পরিমাণ তুলনা করা আসলেই অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষক বেতন সবচেয়ে কম। ভারতে, নেপালে ও শ্রীলঙ্কায় শিক্ষকেরা গড়ে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার সমমূল্যের বেতন পান এবং তাঁদের সামাজিক মর্যাদাও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। ফিনল্যান্ড, জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে শিক্ষক পেশা সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ। এমনকি প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাতেও শিক্ষকদের বেতন বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেশি।
বাংলাদেশে শিক্ষকরা আছেন উন্নয়নের সব আলোচনার বাইরে, বাজেটের ছায়ায়। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এখনও জিডিপির মাত্র ২ শতাংশের কাছাকাছি। যেখানে ইউনেস্কোর প্রস্তাব ৬ শতাংশ। অবকাঠামো উন্নয়ন, রাস্তা নির্মাণ, মেগা প্রকল্পে হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু যে শিক্ষক সেই প্রকল্পে কাজ করার মানবসম্পদ গড়ে তোলেন, তাঁর মাসের শেষে হিসাব মেলে না।
আমরা জানি কোঁকড়ানো মেরুদণ্ড মানেই ভঙ্গুর জাতি। সমাজে আমাদের শিক্ষকরা নানাভাবে অপমানিত হন। সেখানে নৈতিকতা অবক্ষয় পায়, প্রতারণা বৃদ্ধি পায়, আর জ্ঞানের আলো ম্লান হয়ে যায়। ছাত্ররা যখন দেখছে তাদের শিক্ষক রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় বসে সামান্য বাতা চাইছেন তখন তাদের চোখে শিক্ষককে ছাপিয়ে আমাদের, দারিদ্র, দুর্বলতা ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
একজন শিক্ষক ক্লাসে দাঁড়িয়ে যখন পাঠদান করেন, তাঁর কণ্ঠে তখন জ্ঞান বিতরণের সাথে মর্যাদার প্রকাশের আকুতি থাকে। সেই মর্যাদা যদি সমাজ ফিরিয়ে না দেয়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে শিক্ষকতা হয়ে উঠবে কেবল বাধ্যতামূলক পেশা, মহৎ কোন আহ্বান নয়।
তা্ই রাষ্ট্রের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ সরকারী বা বেসরকারী কোনভাবেই নীতি প্রণয়ন, বাজেট বরাদ্দ ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে শিক্ষকদের মতামত দেবার ফুরেসৎ নেই। তাদের দাবি, আপত্তি, সমস্যা সবই কেবল রিপোর্টের ফুটনোটে সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্র যদি এই পরিস্থিতিতে চোখ বন্ধ রাখে, তবে তা কেবল শিক্ষকদের জন্য না হয়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে অচল করে দেবার হুংকারও শোনা গিয়েছিল।
এজন্য শিক্ষককে দ্রুত শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করার পর শিক্ষা উপদেষ্টার মুখে সামান্য হাসির রেখা ফুটে উঠেছে । তাঁর এই হাসি ধরে রাখার জন্য এখন দক্ষিণ এশীয় গড় অনুযায়ী একটি ন্যায্য বেতন ও ভাতা নীতিমালা করে শিক্ষক বেতন কাঠামো পুনঃনির্ধারণ জরুরি হয়ে পড়েছে। পেশাগত মর্যাদা রক্ষা অধ্যাদেশ জারি করে শিক্ষক অবমাননা, হেনস্তা বা অবহেলার ঘটনায় দ্রুত বিচার ও প্রশাসনিক শাস্তিরও ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির কমপক্ষে ৪–৫% এ উন্নীত করা আরো জরুরী।
সামনের দিনগুলোতে শিক্ষকদের দাবি-দাওয়াকে অবহেলা বা আন্দোলনকে দমন না করে সংলাপ ও অংশগ্রহণমূলক নীতি প্রণয়ন জরুরি। শিক্ষককে কেবল চাকুরিজীবী না ভেবে জাতি গঠনের কারিগর হিসেবে দেখতে হবে। সমাজে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার জন্য এটি সরকারী প্রচারের বিষয়ও বটে। রাষ্ট্রের এখনই উচিত সকল পর্যায়ের শিক্ষকদের যে কোন দাবির যৌক্তিক সমাধান করা। না হলে এই অবহেলার মূল্য দিতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
দশদিন ধরে শিক্ষকরা রাস্তায় থেকে জাতিকে যা শেখালেন সেটা শুধু বেতন-ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলনের গল্প হিসেবে ভাবলে ভুল হবে।, এটি জাতির আত্মসমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন ভৌত উন্নয়নের সাথে মানবিক উন্নয়নের যথেষ্ট ফাঁরাক তৈরী হয়ে গেছে। এই বৈপরীত্যই প্রমাণ করে আমরা উন্নয়নকে পরিমাপ করছি ভবন ও সড়কে, কিন্তু মানুষ গঠনের ক্ষেত্রটি বরবরই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। আমরা জানি, যে দেশে শিক্ষক অবহেলিত সেখানে জ্ঞান ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, নৈতিকতা হারিয়ে যায়, ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়।
রাষ্ট্র যদি সত্যিই উন্নয়নের দাবি করে তবে তাকে প্রথমে শিক্ষকের দিকে তাকাতে হবে। কারণ শিক্ষা ও শিক্ষক ছাড়া কোনো জাতির মেরুদণ্ড শক্ত হতে পারে না। আজ সময় এসেছে এই ব্যথিত মেরুদণ্ডকে সোজা করে দাঁড় করানোর। কারণ শিক্ষক রাস্তায় নয় শ্রেণিকক্ষেই মানায়। এ কথাটি ভুলে গেলে সামনের দিনে আমরা সবাই আরও হোঁচট খাবো।
ভবিষ্যতে শিক্ষকরা যদি আবার রাস্তায় নামেন তাহলে হয়তো শিক্ষার্থীরাও তাঁদের সাথে রাস্তায় নামবে। তখন শুধু কেবল বেতন বা ভাতা নয়। তখন প্রশ্ন উঠবে জ্ঞানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমরা জাতির মেরুদণ্ডকে যদি সত্যিই টেকসইভাবে সোজা রাখতে চাই তাহলে এখনই দরকার আমাদের শিক্ষকদের জন্য সার্কভূক্ত দেশ বা বৈশ্বিক আর্থিক সম্মানীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটি ন্যায্য আর্থিক সম্মান ও মানবিক মর্যাদা ফিরিয়ে আনার যথার্থ নীতি নির্ধারণ করার উদ্যোগ নেয়া।
×প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]