মঙ্গলবার | ২৮ অক্টোবর, ২০২৫ | ১২ কার্তিক, ১৪৩২

আমার পরীক্ষায় আমি নিয়ন্ত্রক হবার গ্লানি কতটুকু?

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম :
সারা বিশ্বে এই মুহূর্তে বেপরোয়া যুদ্ধ নিয়ে বেশ গরম পরিবেশ বিরাজ করলেও বাংলাদেশে নির্বাচনী হাওয়া বেশ লু। এদেশের জনগণ যে কোন পক্ষের হোক না কেন, একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আশা করে। রাজনৈতিক দলগুলোও মতপার্থক্য নির্বিশেষে একই মনোভাব পোষণ করে বক্তব্য দিচ্ছে। এমনকি বৈশ্বিক পরিমন্ডল থেকে যারা আমাদের নির্বাচন ব্যাপারে উৎসুক তারাও প্রকারান্তরে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের কথা বলে চলে যাচ্ছেন।
যে কারণে আমাদের নির্বাচন নিয়ে সারা বিশ্বে আগ্রহ তৈরী হয়েছে তা অনেকের নিকট জানা আবার অনেকের নিকট এটি একটি ওপেন সিক্রেট। আসল কথাটি হয়তো সবাই জানেন, বুঝেন, উপলব্ধি করেন কিন্তু প্রকাশ করতে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। এখানে যেসব জিনিষের অভাব তৈরী হয়েছে সেগুলো বহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে ছুঁয়ে দেখার উপায় নেই।
তবে নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে লুক্কায়িত বিষয়গুলো ততই পরিস্কার হয়ে জনমনে ধরা দিয়ে চিন্তার উদ্রেক করে চলেছে। যে মাছ সাধারণ মুঠোজাল দিয়ে ধরা দেবে না সে মাছকে চায়না কারেন্ট জাল দিয়ে নতুবা আলোর ফাঁদ অথবা পানিতে বিদ্দুৎ-এর শক দেয়া যায় এমন কাঠির গুঁতো দিয়ে অবশ করে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবুও নির্বাচন হতে হবে। সেটা সময়মতো হতে হবে বলে চারদিক থেকে কড়া বক্তব্য শোনা যাচ্ছে।
নির্বাচনী নদীতে নিরীহ মাছ হচ্ছে জনগণ। জনগণকে নির্বাচনের নদী-খাল-পুকুরে আসতেই হবে। দেখা যায় না কিন্তু শক খেয়ে কাবু হওয়া যায় এমন জালে বা ফাঁদে গুঁতো খেয়ে ধরা দিতেই হবে। কথা হলো জনগণ যদি ধরা দিতে নদী-পুকুর-খালে না যায় তাহলে কি হবে? কারণ এর আগের নির্বাচনগুলোতে জনঅভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন। সেই হ্যাঁ-না ভোট হোক বা মাঠে কুকুর শুয়ে থাকা নির্বাচন হোক। তখনও ভোট হয়েছে এবং সেই ভোটে কাজ হয়ে কাজের কাজ সচল থেকেছে। তখন কেউ কেউ বলেছিলেন, আমি তো ভোট দিতে কেন্দ্রে গিয়ে দেখি আমার ভোট আগেই কেউ দিয়ে ফেলেছে। তার আঁকুতি হয়তো কোন দয়াবান সংবাদ সংগ্রহকের কৃপায় পরদিন পত্রিকার পাতায় এসেছে। সেসময় ভোটচুরি নিয়ে এত তোলপাড় হয়েছিল, বিচার চেয়ে ধর্ণা দিয়েছিল। তারপর প্রতিপক্ষের ভয়ে বা অজানা কারণে পরে সেটা আর কোনদিন কেউ বলেনি, কেউ প্রচার করেনি।
তবে কোন কোন বিদেশী গণমাধ্যমে সেগুলো ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। কোন কোন দেশের রাষ্ট্রদূত সেগুলো এদেশে বসে বলতে গিয়ে বিব্রত হয়েছেন। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী নিষেধ বলে অনেকে সেজন্য নিজের দেশ থেকে ধিক্কার খেয়ে ফিরে চলে গেছেন বিগত বছরগুলোতে।

তারপর আর কেউ কিছু বলতে গিয়েও বলতে চান না। তারা জেনে ফেলেছেন, এদেশে বেড়ায় ফসল খেয়ে ফেলে। যে সর্ষে দিয়ে নির্বাচনী ভূত-প্রেত তাড়ানোর কথা সেই সর্ষের দানার মধ্যে ভূতের গহীন আস্তানা বিরাজমান। সেসব আস্তানা নানা আর্থ-মনো:সামাজিক ও কঠিন উপাদান দিয়ে সুরক্ষিত করে গড়ে তোলা হয়েছে। সুতরাং, এসব বিয়য়ে কথা বলে কিছুই হবে না।
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের এক সভায় পুলিশ একদিন আগে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পৌঁছাতে চায় বলে মতামত এসছে। ভোটের ঠিক আগের রাতে ব্যালট পেপার কেন্দ্রের মধ্যে থাকাকালীণ বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে যে জটিল সমস্যা তৈরী হয়েছিল সেটা নিয়েই যত কাহিনী প্রচারিত হয়েছে- সেটার একটি হলো ২০১৮ সালে ভোটের আগের রাতে সিলমারা ‘রাতের ভোট’। এই রাতের ভোট নিয়ে একদিন কথা বলতে গিয়ে এক সাবেক জাপানীজ এ্যাম্বাসেডরকে কিরুপ জটিল সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে তা নিয়ন্ত্রণের আগেই গণমাধ্যমের দ্রæতগতির কল্যাণে গোটা বিশ্ববাসী জেনে ফেলেছিল।
তাই আমাদের নির্বাচন নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে তো বটেই, সারা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষের উৎকন্ঠা সেখান থেকে। রাতের ভোটের সেই ঘৃণ্য অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পেতে বর্তমান নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, সংসদ উপনির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন কোথাও আগের রাতে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানো হয়নি। কারণ কেন্দ্রে ব্যালট পেপার থাকার চেয়ে উপজেলা পরিষদের স্ট্রংরুমে গচ্ছিত রাখাই বেশী নিরাপদ। দেশের ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্রে ভোটের আগের রাতে ব্যালট পাঠানোর ঝুঁকি অনেক বেশী। উপজেলায় রাখা হলে সিলমারার ঝুঁকি অনেক কম। বিগত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেটার সুফলও পাওয়া গেছে। তাহলে পুলিশ আবার কেন ভোটের আগের রাতে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পৌঁছানোর কথা বলছে? সেখানেই অনেকের সন্দেহ বলে সেই সভার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
অক্টোবরে ঢাকার কাওলায় এবং ১১ নভেম্বর ২০২৩ মাতারবাড়ির জনসভায় শোনা গেছে- ‘যেভাবেই হোক নির্বাচন এদেশে হবে।’ গণমাধ্যমের কল্যাণে ‘যেভাবেই হোক নির্বাচন’ নিয়ে উৎসাহ বেড়েছে। দ্য গার্ডিয়ান (১০.১১.২০২৩) এটাকে ‘প্রি ইলেকশান ব্রুটাল রিপ্রেশন… দেয়ার আর নো মোর রুম লেফ্ট ইন দা প্রিজনস’ বলেছে। দেশ-বিদেশ ভেদে নির্বাচন সবার চাওয়া। মূল কথা হলো- জনগণ নির্বাচন চায়, কিন্তু যেনতেন নির্বাচন চায় না।
ভোট চলাকালীণ ভোটারবিহীন কেন্দ্রের মাঠে কুকুর শুয়ে থাক সেটা চায় না। ভোটকেন্দ্রে অনাহুত ভূতপ্রেত ঠেকানার জন্য চরমোনাই পীরের মতো প্রার্থীরা আবেদন জানাতে গেলে ভূতপ্রেত বা প্রেতাত্মাদের ঘুসি ও দৈত্যাকার নখের আঁচড়ে নাকমুখ ফাঠিয়ে রক্ত ঝড়াতে চায় না। জনগণ যেনতেন মার্কা প্রহসণের নির্বাচন ঘৃণা করে।
এখন নির্বাচনের আগে সংলাপ নিয়ে জটিলতা তৈরী হয়েছে উভয় পক্ষের শর্তারোপ নিয়ে। উভয় দলের শর্ত বেশ কঠিন। উভয় দল তাদের শর্তের ব্যাপারে অনড়। সরকার পক্ষ বলছে- ‘ওদের চিন্তার দৈন্য আছে’। বিপক্ষরা বলছে- ‘ওদের চিন্তায় অসততা আছে।’ আমি আছি থাকব, নির্বাচন করব। এই নীতি বলবৎ থাকলে সেখানে গণতন্ত্র চলে না। সেখানে সংলাপ হয় না। ক্ষমতায় থেকে আমাদের নেত্রীকে চিকিৎসা নিয়ে কটু কথা বললে আমরা মেনে নেব কেন? দেশের মানুষ এসব কটু কথা ভালভাবে নেয়নি।
উভয় দল বিভিন্ন জনসভায় বলে বেড়াচ্ছেন জনগণ তাদের পক্ষে আছে। কিন্তু সেই জনগণ কারা? একদল বলছেন, ওদের শুধু কর্মী, জনগণ সাথে নেই। আরেকদল বলছেন, ওদেরও জনগণ সাথে নেই, শুধু সরকারী লোক, রঙ্গীন ক্যাপে মাথা ঢেকে জনসভায় বসে থাকে। যারা চাকুরীর তাগিদে ভয় পেয়ে সাথে আছেন। অন্যদিকে বৈশ্বিক ব্লক নিয়ে ভাগাভাগি করে কেউ বলছেন চায়না, রাশিয়া কেউবা আমেরিকা, ইউরোপের কথা। আবার কেউ মজা করে বলেই ফেলছেন, খেলা হবে… দিল্লী বহুদূর…। প্রতিপক্ষ কাউন্টার দিয়ে বলছেন, কার সাথে খেলতে চান? আসল খেলোয়াড় সবাই তো জেলে…, ইত্যাদি।
এতসব শুনে মনে হচ্ছে, আমাদের নিজস্ব স্বত্তা বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই! নির্বাচনের আগে বৈশ্বিক ব্লকের ভাগাভাগি নিয়ে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে তাতে সাধারণ জনগন বেশ হতাশ। তারা মনে করছেন নেতাদের দেশপ্রেম নেই। বৈশ্বিক বøকের ভাগাভাগি নিয়ে নেতাদের অন্ত:সারশুণ্যতা আমাদের দেশের ভিতকে অচিরেই আরো বেশী নড়বড়ে করে দিতে পারে।
নিজে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে রত থেকে নিজের নির্বাচনী পরীক্ষা নিজে নেবার ফন্দি জনগণ জানে। নিজের পরীক্ষায় নিজে ইনভিজিলেটর হওয়া বা গার্ড দেয়া অনৈতিক। এই ফন্দি শুধু লজ্জাষ্কর নয়, বেআইনী। এমন অনৈতিক, অপরাধ করতে কারো এত আগ্রহ কেন? তাই তাদের প্রতিপক্ষের একনম্বর শর্ত হলো পদত্যাগ করে তারপর নিজে নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে দাঁড়ান।
আসলে যে কোন বিষয়ে একটি ভাল সমঝোতার জন্য যারা বেশী সবল বা ক্ষমতায় থাকে তাদেরকে আগে এগিয়ে আসতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক কৃষ্টি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে কেউ কোন বড় সমস্যা ঘটালে বা বড় দোষে দোষী প্রমাণিত হলেও কখনই পদত্যাগ করতে চান না। উল্টো বাগাড়ম্বর শুরু করেন। নিজের চরকা ঠিকমতো না ঘুড়লেও অন্যের ব্যাপারে নাগ গলিয়ে ব্যঙ্গ করতে তৎপর থাকেন।
এমন হীন অবস্থায় দেশে নিম্নআয়ের মানুষেরা বিপাকে পড়ে কষ্ট পান। তখন সুযোগ নেয় মুনাফালোভী অসাধু লোকেরা। তাদের বেআইনী কাজের শাস্তিপ্রদান দূরে থাক তদারকি করার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। সমাজ ও দেশ হয়ে পড়ে অস্থির। যেটা আমাদের দেশের নিত্য পণ্যের বাজারে ভয়ংকর সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
সবপক্ষের বিপুল জনসমর্থন থাকার দাবীদার, জনকল্যাণ সাধনের দাবীদার হয়ে সেই জনগণকে উপেক্ষা করে অসাধু উপায়ে নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার চিন্তা করার মধ্যেও কোথায় যেন ফাঁরাক তৈরী করা হয়েছে বলে ধারণা হয়। সে বিষয়ে কিছু ভয় ও সন্দেহ তৈরী হয়ে যায় অনেকের মনে। তাহলে এসব দিয়ে কি আসল ভোটারদের কোনরূপ কল্যাণ সাধন হয়নি?
নিজের নির্বাচনী পরীক্ষা নিজের অধীনে নেবার ইচ্ছার পেছনে ‘ওপেন সিক্রেট’অন্যায়ের গ্লানিটুকু যদি কাউকে স্পর্শ না করে তাহলে সাধারণ অবুঝ মানুষও তাদের ক্ষেদোক্তি করতে কুন্ঠিত হবে না। দেশের মানুষ রাজনৈতিক সমস্যার পুলিশি সমাধান চায় না তাই ছাড় দেবার প্রশ্নই উঠে না, আর বিদেশে আমাদের দুর্ণাম আরো বেড়ে যায় দিন দিন। এভাবে বিদেশী বেনিয়াদেরকে আমরাই আমাদের দুর্বল জায়গায় প্রবেশ করার সুযোগ আর কতদিন দেব?
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.