–প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
গোটা এশিয়া জুড়ে এবার উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশের উচ্চতাপমাত্রা যেমন নজর কেড়েছে তেমনি প্রাণ ওষ্ঠাগত করে বিপদে ফেলেছে মানুষকে। কেউ কেউ মজা বা উপহাস বলে বলে বেড়াচ্ছে, মানুষের পাপ কাজের মাত্রা বেড়েছে। পাপ কাজকে কেউ এখন আর তেমন ঘৃণা করেনা, ভয়ও পায় না। কারণ এদেশের মানুষ সিংহভাগই ধর্মপ্রাণ। এদেশের মতো এত বেশী মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে বলে মনে হয় না। মানুষ পাপ কাজ করে আর ধর্মীয় উপাসনা করে প্লাস-মাইনাস থিওরীতে মনের ভারসাম্যতা এনে আত্মতৃপ্তি লাভ করে।
কিন্তু সেই আত্মতৃপ্তি সবার ক্ষেত্রে টেকসই হয় না। কারণ, মানুষ বার বার তওবা করে আবার বার বার পাপ কাজ করতে উদ্যত হয়ে উঠে। ফলে সীমা লঙ্ঘণ করার অপরাধেপ্লাস-মাইনাস থিওরীতে মনের পাপ বিদূরিত হয় না। বরং আরো বেশী কালিমা লেপন হয়ে যায়। ফলত: পাপের বোঝা ক্রমাগত ভারী হয়ে উঠায় বর্তমানে পাপমাত্রা বেশী ভারী হয়ে অসহনীয় হয়ে উঠেছে!
এছাড়া শুধু প্রার্থনা না করলেই পাপ হয় অথবা প্রার্থনা না করলেই মার্জনা হয় এমন ধারণা সব ধর্মের সবাই মানতে নারাজ। ইসলামে ধর্মীয়ভাবে হয়তো সীমা লঙ্ঘণকারীদের জন্য এই ধারণা সঠিক কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে সীমালঙ্ঘণকারীদের বেলায় কি হবে?
মানুষ নিজেদের আরাম আয়েশের জন্য প্রকৃতির উপর নির্বিচারে নিষ্ঠুরতা চালিয়ে উল্লাসে মেতে উঠেছে। উন্নয়নের নামে প্রকৃতির সবুজ গায়ের চামড়া তুলে কালো পশমী চাদর ও জামা পরিয়ে দিয়েছে। গরমের মৌসুমে মানুষ বা কোন প্রাণি কি কালো পশমী কোট পায়ে দিয়ে থাকতে পারে?
আধুনিকতার নামে শহরের ব্যাপ্তি ঘটছে প্রতিটি দেশে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির নামে গোটা পৃথিবীর বুক জুড়ে কংক্রট ও কালো পীচের ঢালাই এঁকে দেয়া হয়েছে। ক্ষমতার লোভে যুদ্ধের দামামা চালিয়ে সাইরেনবাজিয়ে বোমা বারুদ ফাটিয়ে পৃথিবীর শান্ত সুন্দর পরিবেশকে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে।আরাম আয়েশের জন্য এসি, কুলিংফ্যান, ফ্রীজ নামক কীট মানুষের গাড়ি, বাড়ি, অফিস, আদালত, রিসোর্ট প্রভৃতিতে খামচে বসে অনর্গল উচ্চ তাপমাত্রা ও বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে দিয়ে উপহাস করছে। কার্বণ কমানোর নামে সেমিনার, কনফারেন্স, কনভেনশন করতে গিয়ে বেটো দিয়ে ওয়াক আউট করে চলে যাচ্ছে স্বার্থের সংঘাতের কারণে। মারণাস্ত্র বিক্রি করে যাদের জাতীয় ও বার্ষিক আর্থিক বাজেট নিরুপণ করা হয় তারা এ ব্যাপারে শুধু ভণিতা ছাড়া আর কি করতে পারে? তাই পাপমাত্রা শুধু ধর্মপ্রাণ মানুষকে কেন্দ্র করে প্রার্থণার উপর নির্ণীত করাটা বড় ভুল হবে। পাপের মাত্রাটা নির্ভর করছে বড়বড় অর্থনীতির বড় বড় মেগা কর্মকান্ডের ফলে প্রকৃতির উপর ব্যাপক হারে নিষ্ঠুরতা চালানোর মধ্যে।
আসলে যুদ্ধের উন্মাদনায় পড়ে বৈশি^ক উষ্ণতাকে কেউই তেমন পাত্তা দিচ্ছেন না। কিছুদিন আগে বলা হতো- পৃথিবী আর দেড় বছরের মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ হারাবে। হঠাৎ করে এখন বলা হচ্ছে, দেড় বছর নয় আর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে পৃথিবীর ভাগ্য জানা যাবে(বিবিসি)। কারণ, আর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে যে বিশ^ পরিবেশ সম্মেলন হতে যাচ্ছে সেখানে বড় বড় কার্বন নি:সরণকারী দেশগুলোর ভূমিকা কি হবে তা দেখার মতো বিষয়। সেখানে নির্ধারিত হবে কার্বন নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন নীতিমালা।
রাশিয়া গ্যাস সরবরাহে ইউরোপের উপর থেকে অবরোধ তুলে না নেয়ায় গোটা ইউরোপে কাঠ ও কয়লার ব্যবহার বেড়ে গেছে। তাই ইউরোপে অতি বেশী কার্বণ নির্গমণ হতেই আছে। এটা আরো কতদিন বা বছর কলবৎ থাকবে তা বোঝা মুষ্কিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাবস্থায় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ চলছে। ইরান, লেবাননসহ গোট মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি। সবার সামরিক উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এবং দ্রব্যমূল্য আরো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে।
বিশ্ব^বাণিজ্য ও জরুরী খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ আরো বেশী সংঙ্কুচিত হয়ে পড়লে বিশ^মন্দা নিয়ে মানুষ আরো বেশী হতাশ হয়ে যাবে। তখন ধনী দেশগুলো কার্বন নি:সরণের জন্য কোনরুপ অর্থ ব্যয় করতে মোটেও রাজী হবে না। ফলে গোটা বিশ্ব অচিরেই একটি চরম ক্রান্তিকালের মুখোমুখি এসে উপনীত হয়েছে। সেখান থেকে অচিরেই কোন মুক্তির পাবার আশা করা বৃথা।
এতো গেল ইউরোপের ধনী দেশগুলোর কথা। করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট,বন্যা, দাবানল, ডেঙ্গু, মরুর দেশ আমীরাত ও ওমানে আকস্মিক অতিবৃষ্টি ও ফ্লাশফ্লাড, ইত্যাদি নিয়ে গোটা পৃথিবীতে কঠিন অর্থনৈতিক আঘাত লেগে গেছে। বড় আঘাতে ইতোমধ্যে আফিকা ও এশিয়ার ছোট ছোট ১৬টি দেশ নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে। দেশে দেশে জ্বালানী সংকট ও উচ্চদ্রব্যমূল্য চোখে পড়ার মতো অবস্থায় জানান দিচ্ছে সামনের ভয়াবহ আশঙ্কার কথা।
আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ষোল হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার মাত্রা সফলভাবে প্রচারিত হলেও সাম্প্রতিক ভয়াবহ তাপপ্রবাহ ও জরুরী এলার্টের ফলে মানুষ ঘরে বসে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে। এসময় বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার ঘন ঘন লোড শেডিং মানুষকে জানান দিচ্ছে- এটাই যথেষ্ট নয়। এখন ব্যাটারী চালিত অটোরিক্সার সংখ্যা কত কোটি হয়ে তা কারো জানা নেই। অটোর চার্জ্জ, সেচ মেশিনের অতি ব্যবহার ও অতি গরমে গ্রামের মানুষও দেশীয় তৈরী সস্তা এসি কিনে ঘরে ঘরে লাগাচ্ছে। তাই বিদ্যুতের সংকট আরো বেশী ঘণীভূত হচ্ছে।
আমি একজন আশাবাদী মানুষ। চিরকাল আশা ও ভরসার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর সকল হতাশাকে জয় করে মানুষ বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাক্ সেই চেষ্টা করি। এখনো করছি এবং ভবিষ্যতে সেটা করেই যাব। কিন্তু মানুষের কাজের গতি বন্ধ হয়ে গেলেই তো সম্ভাব্য বিপদের হাতছানি চলে আসে।মানুষের দেহে যেমন রক্তপ্রবাহ সঠিক থাকা জরুরী ঠিক তেমনি একটি দেশের সারাদেহে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্দুৎপ্রবাহ থাকাটা খুব জরুরী।
সমস্যাটা এখানেই অনুভব করছি। পড়াশুনা ও গবেষণার জন্য দীর্ঘদিন জাপানে ছিলাম। প্রথমদিকে দেশ থেকে জাপানে গিয়ে মনে হতো সেখানে কি রাত হয় না? রাতের রাস্তায় কারো ঘুম নেই। সেটা গাড়ি, ট্রেন বা মানুষের। কোন শব্দ নেই শুধু আলো আর আলো। সবাই শিফট বদল করে নিজের কাজ করেই যাচ্ছে। ওর মধ্যেই বিরাম, বিশ্রাম চলছে। কেউ কাউকে কোনভাবেই ডিস্ট্রার্ব দিচ্ছে না। ওরা তো গ্যাস, তেল সবই কিনে আনে। নিজের কিছুই নেই। তবুও ওদের অভাব নেই। ও হ্যাঁ, এখনো ঢাকার চেয়ে টোকিও বা পাশের শহরতলির নির্মাণ খরচ ও জমির দাম অনেক কম। ওদের তো বিদ্দুৎ রেশনিং করতে হয় না। ওখানে এক মিনিট কেন, এক সেকেন্ডের জন্য বিদ্দুৎ কোথাও চলে যায় যায় না। কারণ ওরা খুব সৎ ও কর্মঠ। ওরা মুখে প্যাঁচ প্যাঁচ করে বাহুল্য কথা বলে না। কথায় ও কাজে সততাকে প্রমাণ করে দেখায়। আমরা চোরের খনিতে বাস করি। এটা নতুন কথা নয়। রেন্টাল বিদ্দুৎ-এর প্রভাবে টাইকুনরা এই চরম বিপদের সময় চুপ করে আছেন কেন?
এপ্রিল শেষ হলো কোনা বরিষণের দেখা নেই। আবাদী জমি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্চে। সেচ দেবার উপায় নেই। কারণ, পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। সাথে চরম অভাব লেগেছে বিদ্দুৎ সরবরাহে।
গতবছর প্রথম দেশে জানা গেছে লোডশেডিং-এর প্রাতিষ্ঠানিকিীকরণ করার কথা। সেটা সরকারীভাবে রাখঢাক না করে সময়সূচি ধরে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ঘোষণা অনুযায়ী লোডশেডিং-এর ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে না বলে সারা দেশের জনগণ অভিযোগ করে চলেছেন।চাহিদা অনুযায়ী দুরে থাক্, এমনিতেই তো বিদ্দুৎ থাকে না। চাহিদা মতো ভোক্তাকে বিদ্দুৎ দিতে না পারলে তো ক্ষমা চাইতে হয়। এটা আমাদের কৃষ্টিতে নেই অথচ, ক্ষমা চাওয়াটাই ভাল উপায়। তা না করে লোডশেডিং-এর অনিয়ম কথাটা শুনতে ও বুঝতে গিয়ে অনেকে আরো বেশী কষ্ট পাচ্ছেন, হতাশ হয়ে পড়ছেন।
এবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাশ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রাইমারী স্কুল খোলা। দেশে এসি সম্বলিত ক্লাশরুম কয়টি বিদ্যালয়ে আছে? এই ভয়াবহ গরমে সবার আগে কোমলমতি শিশুদের জন্য স্কুল বন্ধ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও তা বলবৎ করা হচ্ছে না। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবাই হলে থাকে না। ফলে অনলাইনের খরচে কারণে শিক্ষার্থীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে সংকটে পড়ে অনুপুস্থিত থাকছে।
এগুলোই আমাদের দেশের সেবাদানকারীদের সাথে উন্নত কোন দেশের সেবাদানকারীদের তফাৎ। কেউ কি সেটা বুকে হাত দিয়ে অস্বীকার করতে পারবেন? জোড়াতালি দেয়া জীবনে আমাদের সবাইকে কেন বিদ্দুৎ কষ্টে থাকতে হবে? অভিজাত এলাকা ও বস্তি বা দুর্গম গ্রামীণ এলাকায় বাস করা সবাই তো রক্তমাংসের মানুষ। তাদের কারো শরীরে কি ঠান্ডা ও গরমের মধ্যে অনুভূতির কি কোন পার্থক্য আছে?
লোডশেডিং-এর জন্য যাদের চারতলার চৌবাচ্চায় কৃত্রিম পানি তুলে শিং-মাগুর মাছের প্রজেক্ট আর চলছে না,যাদের ছাদবাগানের গাছগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে তাদের কথা আলাদা করে ভাবার অবকাশ নেই। রাজধানীর কোন কোন রাস্তায় সিটি কর্পোরেশনের কতটি গাড়ি পানি ছিটাচ্ছে বস্তি এলাকার কলসী কাঁখে খাবার পনি সংগ্রহ করতে যাওয়া দরিদ্র মানুষগুলোর নিকট সেটাও খুব বাহুল্য বা কৌতুক মনে হচ্ছে। যাদের প্রিয় ছেলের কিনে দেয়া এসিটাও চালানো যাচ্ছে না,আইপিএসে চার্জ না হওয়ায় সিলিং ফ্যানও ঘুরছে না তাদের জন্য সবকিছু হতাশার মধ্যে নিপতিত হলেও তালের হাতপাখা দু’টো কিন্তু চালানো যাবে। কারণ, আমি আশাবাদী মানুষ। মরুশহর দুবাইয়ে হঠাৎ তীব্র বন্যার মাত্রা ওদের অধিবাসীদের পাপমাত্রার কারণে ঘটেছে তা বলা মুষ্কিল। কারণ সেখানে শত শত ভিন্নধর্মাবলম্বী লোকের বাস। কিন্তু আমাদের দেশের উপর কি হলো? বিপদ বার বার আসে এজন্য বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতেই হবে। আর এজন্য আগাম বড় পরিকল্পনা এখনই গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত।
*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]