ইমাম হাসান মুক্তি :
নাটোরের লালপুরে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সমন্বিত সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত ২৫টি গভীর সেচ পাম্প প্রায় ১৩ থেকে ৫৪ বছর ধরে অকেজো পড়ে আছে। এতে কৃষকের সেচ ভোগান্তি ও খরচ বেড়েছে। অগভীর নলকূপ স্থাপন করে শুষ্ক মৌসুমে ঠিকমতো পানি পাচ্ছেন না।
প্রকল্পের তদারকি কমিটি ও কর্মকর্তার এবং পরিবার কেন্দ্রিক ড্রাইভার ও ম্যানেজার হওয়ায় এ প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে।
বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ জোন নাটোরের বড়াইগ্রাম অফিস থেকে জানা গেছে, বিএডিসির সমন্বিত সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় লালপুর উপজেলা এলাকায় সেচ সংকট দূর করতে ২ কিউসেট ক্ষমতা সম্পন্ন ২৯টি গভীর সেচ পাম্প স্থাপন করা হয়। প্রতিটির বার্ষিক ভাড়া ছিল সাড়ে ২৩ হাজার টাকা। বর্তমান ৪টি পাম্প চালু রয়েছে। সেগুলো হলো, দুড়দুড়িয়ার বসন্তপুর, অর্জুনপুর-বরমহাটির (এবি) পটিকাবাড়ি, দুয়ারিয়ার মাঝগাঁও এবং ওয়ালিয়ার দিলালপুর।
ট্রান্সফরমার ও তার চুরি, আবাদ পরিবর্তন, কৃষকদের অনাগ্রহ এবং কমিশনিং না হওয়ায় গোপালপুরের বিরোপাড়া (২০০৭) ও মহিষাখোলা (২০০৪), চংধুপইলের কামারহাটি (২০০২), ওয়ালিয়ার দিয়াড়পাড়া (২০০২) ও ওয়ালিয়া (১৯৭৬), ময়না (-), আড়বাবের কচুয়া (২০০১), কৃষ্ণপুর (-), কেশববাড়িয়া (-), হাবিবপুর (-), আড়বাব (১৯৭০) ও হাসবাড়িয়া (২০০১), ঈশ্বরদীর চামটিয়া (-), দুড়দুড়িয়ার মির্জাপুর (২০০২), বিলমাড়িয়ার বড়বাদকয়া (২০০৪), উধনপাড়া (২০০৩), রামকৃষ্ণপুর (-) ও রহিমপুর (২০০২), অর্জুনপুর-বরমহাটির ডহরশৈলা-১ (২০১০), ডহরশৈলা-২ (২০০০), অর্জুনপুর (১৯৭৬) ও বরমহাটি (২০০৩), দুয়ারিয়ার রামকান্তপুর (২০০৩), কদিমচিলানের ভবানীপুর (-) ও কদিমচিলান (২০০৭) স্থাপিত পাম্প বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে পাম্পের মালিকানা দ্বন্দ্ব ও ভাড়া বকেয়াসহ বিভিন্ন কারণে ২৫টি পাম্প বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে ৫টি বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহণ করেছে। বর্তমান মাত্র ৪টি পাম্প চালু রয়েছে। এসব পাম্পের বিপরীতে ৪ লাখ ১৮ হাজার টাকা ভাড়া বকেয়া আছে। ২০১৭ সালের জুন মাসে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়।
উপজেলার বিলমাড়িয়া ইউনিয়নের উধনপাড়া মৌজায় আলহাজ্ব শাফায়েত উল্লাহ বলেন, তাঁর জমিতে (জেএল নং-২৪, দাগ নং-১৩৯) নির্মিত হলেও প্রকল্পের ম্যানেজার বজলুর রহমান ও ড্রাইভার তার ছেলে আনিসুর রহমান। এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ লাইন দন্ডায়মানসহ সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও প্রকল্পের অসৎ কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রকল্পের ড্রাইভার ও ম্যানেজার পরিবার কেন্দ্রিক হওয়ায় এলাকায় ওই প্রকল্পের সেচ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সেচের বেশি মূল্য নির্ধারণ করতেন। অতিরিক্ত আদায় অর্থ নিজেরাই ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতেন। এ সময় কৃষকরা ডিজেল চালিত স্যালো ব্যবহারে করে লাভবান হতেন। ওই সময় শুধু ওই প্রকল্পের তদারকি কমিটি ও কর্মকর্তার এবং পরিবার কেন্দ্রিক ড্রাইভার ও ম্যানেজার হওয়ায় এ প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে।
সরেজমিন (৪ মে ২০২৪) ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার বিলমাড়িয়া ইউনিয়নের উধনপাড়া মাঠের মধ্যে পরিত্যক্ত ছোট একটি ঘর। ঘরের ভিতরে-বাহিরে গজিয়েছে গাছ, ময়লার স্তুপ। সেচ পাম্পগুলো অকেজো পড়েছে আছে, নষ্ট হয়েছে গেছে যন্ত্রাংশ। এক সময় এখান থেকে কৃষকের ক্ষেতে পানি সেচ দেওয়া হতো এমনটি বোঝার কোন উপায় নেই। সরকারের সেচ পাম্পগুলো চালু থাকলে ৫০০ টাকায় এক বিঘা জমি সেচ দেওয়া যেত। এগুলো বন্ধ থাকায় এখন এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে ৪ লিটার ডিজেল ও একজন শ্রমিকসহ ১ হাজার টাকা খরচ হয়।
কৃষক জিয়াউর রহমান বলেন, কোটি কোটি টাকা ব্যায় স্থাপন করা গভীর সেচ পাম্পগুলো কোনো কাজে আসছে না। মালিকানা নিয়ে কোন্দলের কারণে দীর্ঘদিন এগুলো ব্যবহার হয়নি। চালুর জন্য কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নেয়নি। এখন পানি সংকটে ক্ষেতে পাটের বীজ বপন করা যাচ্ছে না। যার ফলে হাজার হাজার বিঘা জমি পতিত পড়ে আছে। দেশের কোটি কোটি টাকা লোকশান হচ্ছে।
কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, আগে দুই মৌসুমে ধানের আবাদ হতো। নলকুপ বন্ধ থাকায় এখন শুধু বর্ষায় আবাদ হয়। কৃষকরা সেচ সংকটের কারণে সবজি ও ভুট্টার চাষ করছেন বেশি। চাষাবাদে খরচও দ্বিগুণ হচ্ছে। এক বিঘা জমি সেচ দিতে ১ হাজার টাকা লাগছে। অথচ গভীর পাম্পগুলো দিয়ে সহজে সেচ দিয়েছে চাষাবাদ করা যেত। এখন খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করছেন। তবে কাঙ্খিত ফলন না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বালিতিতা গ্রামের সামসুল ইসলাম বলেন, তার বাড়িতে ১২০ ফিট বোরিংয়ের একটি নলকুপ আছে। সেটি ১৫ ফিট নিচ থেকে বাটেটের সাহায্যে পানি তোলা হতো। এখন সেটি দিয়ে পানি উঠছে না। আমাদের এলাকায় ৮০-৯০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত। গত তিন-চার বছর ধরে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। বর্তমানে কোনো কোনো এলাকায় ১২০-১৩০ ফুট বোরিং করেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
লালপুর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী রবিন আহমেদ বলেন, উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পানির লেয়ার পরীক্ষা করে দেখা গেছে গড়ে ৩৪ ফিট নিচে নেমে গেছে। যা সাধারণত ২০/২২ ফিট থাকে। কোথাও যেন সুপেয় পানি সংকট না থাকে এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
লালপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রীতম কুমার হোড় বলেন, গত এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো বৃষ্টির দেখা মেলেনি। কৃষকরা অগভীর নলকূপ স্থাপন করে চাষাবাদ করায় খরচ বাড়ছে। শুষ্ক মৌসুমে সেচ সংকট দেখা দিচ্ছে। বৃষ্টির অভাবে রবিশস্য এবং আম, লিচুর গুটি ঝরে যাচ্ছে। খরা মোকাবেলায় কৃষকদের কৃষি বিভাগ থেকে ঘন ঘন সেচের পাশাপাশি আম ও লিচুর গুটিতে পানি স্প্রে করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ জোন বড়াইগ্রামের সহকারী প্রকৌশলী জিয়াউল হক বলেন, লালপুর ও বড়াইগ্রামে ৮৯টি সেচ পাম্প রয়েছে। এর মধ্যে ৫০ টি চালু রয়েছে। ৮টি বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহন করেছে। বাকী ৩১ টি চালু করার চেষ্টা চলছে। তিনি আরো বলেন, বন্ধ সেচ পাম্প গুলো চালু করা সম্ভব হলে প্রায় দুই হাজার কৃষকের প্রায় ৫ হাজার বিঘা জমির সেচ দেওয়া সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, পাম্প মালিকদের অনাগ্রহ, মালিকানা নিয়ে দলীয়করণ, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও আবাদের ধরণ পরিবর্তনের কারণে চেষ্টা করেও পাম্পগুলো সচল করা যায়নি। পাম্পগুলোর বকেয়া পরিশোধসহ বিদ্যুৎ বিল ও ট্রান্সফরমার বিদ্যুৎ অফিস থেকে প্রাপ্তি সাপেক্ষে কৃষকরা চাইলে অকেজো পাম্পগুলো সচল করে সেচের উপযোগী করতে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
উপজেলা সেচ কমিটির সভাপতি এবং লালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমিন আখতার বলেন, কৃষকরা আবেদন করলে সেচ কমিটির মাধ্যমে বরাদ্দ এনে পাম্পগুলো চালুর ব্যবস্থা করা হবে। সেচ কমিটির পরবর্তী মিটিংয়ে বিষয়টি আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক মো. আব্দুর রশীদ বলেন, স্বাভাবিকভাবে চৈত্র মৌসুমে পানির স্তর নেমে যায় আবার বর্ষা মৌসুমে উঠে আসবে। তবে সমস্যা হচ্ছে বর্ষা মৌসুমে যেসব এলাকায় স্তর উঠছে না, সেই সমস্ত এলকাকে প্রাধান্য দিয়ে পানির স্তর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।