বৃহস্পতিবার | ২১ নভেম্বর, ২০২৪ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১

প্রান্তিকজনের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যেমন

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বলতে আসলেই কি বুঝায় তা এখনও আমরা সবাই বুঝি না। এমনকি বুঝতে চেষ্টাও করি না। শিক্ষিত, শহুরে, ধনী, সভ্য জনগোষ্ঠীর মধ্যেও কারো মানসিক সমস্যা হলে যদি বলা হয় আপনার মানসিক সমস্যা থাকতে পারে, তাহলে তিনি অবাক হয়ে অথবা রেগে মেগে সেটা অস্বীকার করে পরিস্থিতি খারাপ করে ফেলতে পারেন। অথবা দীর্ঘদিন ধরে কোন স্বজন বা বন্ধুদের মধ্যে যদি কারো কোন মানসিক সমস্যা আঁচ করে বলা হয়, চলো তোমাকে একজন মানসিক চিকিৎসকের নিকট নিয়ে যাই। সেক্ষেত্রে সেও আপনার বিরাগভাজন হয়ে বন্ধুত্ব ত্যাগ করে চলে যেতে উদ্যত হবে। অথবা বলতে পারে, আমি কেন সাইকিয়াট্রিষ্টের কাছে যাব? আমি কেন মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হব? আমি কি পাগল?
এক্ষেত্রে অনেক চেষ্টা-তদ্বির করে হয়তো সবার অজান্তে গোপনে কোন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে নামকরা কোন মানসিক চিকিৎসকের কাছে তার চিকিৎসা সেবা শুরু হয়। বিত্তশালী পরিবারের কেউ হলে তার ভাগ্যে বিদেশে চিকিৎসাসেবা নেবার সুযোগ ঘটে যায়।
কিন্তু আমাদের দেশে গ্রামীণ, রিমোট এলাকার অসহায়, দরিদ্র কোন প্রান্তিকজনের মধ্যে যদি কারো মানসিক সমস্যার উদ্রেক হয় তাহলে তাকে কোনরুপ বাদবিচার না করে সরাসরি পাগলের খাতায় তার নাম তুলে দেয়া হয়। তার বাবা-মা-ভাইবোনকে বলা হয় অমুক পাগলার বাপ-মা অথবা ভাই-বোন ইত্যাদি। তাদের গোটা পরিবারটি ষ্টিগম্যাটাইজড্ হয়ে আসল নামপরিচয় হারিয়ে ফেলে।
এ ধরণের পরিবারগুলো পাগলের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে একঘরে হয়ে পড়ে। তাদের সংগে কেউ ছেলেমেয়ের বিয়ে-সাদী পর্যন্ত দিতে চায় না। অনেকে তাদের সাথে ব্যঙ্গ করে কথা বলে। তাদের আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় মানসিক রোগি নিয়ে হাসপাতালে দোরগোড়ায় যাবার সুযোগ পায় না। চিকিৎসাহীনতায় অনেককে অন্ধকার কুটরির মধ্যে আটকিয়ে রাখা হয়। লোকচক্ষুর অন্তড়ালে রাখার জন্য হাতে পায়ে লোহার শেকল পরিয়ে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। বাইরের আলো-বাতাস, রূপ-গন্ধ, শিক্ষা-দীক্ষা কিছুই তাদের ভাগ্যে জোটে না। বাবা-মা তাদের আপন সন্তানকে বছরের পর বছর, এমনকি যুগ যুগ ধরে লোহার শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছেন-এমন নিষ্ঠুর ঘটনা গণমাধ্যমে প্রায়শই: খবরের শিরোনাম হয়ে আসে।
এসব খবর দেখে তাদেরকে খুঁজে বের করে অবিভাবকদেরকে আর্থিক লোভ দেখিয়ে একসময় এসব মানসিক রোগীকে মাফিয়া ভিক্ষুক ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যায়। মাফিয়া গ্যাংরা তাদেরকে জনবহুল শহরের মধ্যে অমানবিক পদ্ধতিতে ভিক্ষাবৃত্তিতে লাগিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে লিপ্ত হয়। এদের অনেকে কৌশলে পালিয়ে যায়। এছাড়া অনেক অভিভাবক এদের জন্য অন্ন, বস্ত্রের যোগান দিতে অপারগ হলে দূরের কোন অজানা জায়গা বা শহরে ছেড়ে দিয়ে আসার মতো ঘটনাও শোনা যায়।
এজন্য আমরা নানা জায়গায় হঠাৎ বিচিত্র মানসিক রোগি দেখতে পাই। এছাড়া জীবন যন্ত্রনার উপশম ঘটাতে প্রতিদিন পথে-ঘাটে কত মানুষ পাগল সেজে অথবা পাগল হয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেউ বস্তা, চট, ছেঁড়া কাথা-কম্বল ইত্যাদি জড়িয়ে মাথায় ঝুটি, পুঁতিগন্ধময় দেহ নিয়ে রেলষ্টেশন, বাস টার্মিনাল, ফেরীঘাট, মাজার, আশ্রম ইত্যাদিতে ঠাঁই নেয়। যেখানে পঁচা, বাসি যা পায় তাই আহার করে। কেউ ভিক্ষা করে পেট চালায়। তারা কি সবাই আসলে পাগল? এমন প্রশ্নের সদুত্তর হয়তো আমাদের কারুরই জানা নেই। কারণ, এদের স্থায়ী কোন ঠিকানা নেই, নেই সঠিক পরিসংখ্যান ।
অসহায়, দরিদ্র প্রান্তিকজনের মধ্যে কুসংস্কারের প্রাবল্যে বেশী থাকায় জটিল মানসিক রোগি নিয়ে তারাই বেশী যন্ত্রণা পায়। একদিকে সমাজিক ভয়, অন্যদিকে সচেতনতার অভাব তাদেরকে আরো বেশী নিগৃহীত করে তোলে। আমাদের দেশে গ্রামীণ পর্যায়ে সাধারণ রোগিদের যথার্থ চিকিৎসা হয় না, মানসিক রোগিরা আরো বেশী পর্যুদস্ত। মফস্বলে এখনো মানসিক রোগিদের ক্ষেত্রে কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠনিক কাঠমোযুক্ত চিকিৎসাব্যাবস্থা গড়ে উঠেনি।
ইউনিয়ন পর্যায়ে কম্যুনিটি হাসপাতাল শুধু নামেই গড়ে উঠেছে। সেখানে পাশকরা ডাক্তারগণ যেতে চান না। ইউনিয়ন, উপজেলা এমনকি জেলা পর্যায়েও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার কোন ব্যবস্থা নেই। মেডিকেল কলেজবিহীন জেলা শহরে কোন মানসিক চিকিৎসক খুঁজে পাওয়া মুষ্কিল। ‘বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ফর সাইক্রয়াট্রিষ্ট’প্রদত্ত পাঁচটি গাইডলাইনের পরামর্শ ততদূর পৌঁছায় না। অতি দারিদ্রের কারণে ডিজিটাল সুবিধার বাইরে থাকায় ‘টেলিমেন্টাল হেলথ’ এবং ‘এমএইচ গ্যাপ’-এর বাণী তাদের নিকট পৌঁছানোর কোন উপায় নেই।
তাই অবৈজ্ঞানিক মানসিক চিকিৎসার বাজার বেশ জমজমাট। গ্রামে কারো কোন মানসিক সমস্যা দেখা দিলে সর্বপ্রথমে জ্বিন-ভূতের আঁচড় লেগেছে বলে তাকে কবিরাজের নিকট নেয়া হয়। কোথাও ওঝার ঝাড়ফুঁক কোথাও মুন্সিদের জ্বিনপরী ছাড়ানোর নাম করে অত্যন্ত নির্মমভাবে মারপিট করে রোগিকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
এসকল অসহায়, দরিদ্র প্রান্তিকজনেরা তাদের নিজের ও পরিবারের ভরণপোষণ ও সাধারণ চিকিৎসাখরচ জোগাতে অপারগ। এসব মানুষ নিজেদের মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খেয়ে থাকেন। এমতাবস্থায় কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা খরচ জোগানো তাদের পক্ষে আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র।
যারা নিজেদের মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণ করতে অক্ষম তাদের জন্য এবছরের মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের শ্লোগান- আপাত:দৃষ্টিতে একটি আমার আলো নিয়ে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের থিম হচ্ছে, “মানসিক স্বাস্থ্য হচ্ছে একটি মানবাধিকার।”এছাড়া মানসিক স্বাস্থ্যদিবসের অপরিবর্তনীয় শ্লোগান হচ্ছে. “আমাদের চারপাশের মানসিক স্বাস্থ্যসম্পর্কিত কলঙ্ক দূর করতে একসংগে কাজ করি।”
কথা হলো বিশ্বজুড়ে দিবসের শেষ নেই। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলের জন্য আজকাল কিছু কিছু দিবস পালন করা একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। এসব দিবস পালনে কিছু মানুষের ব্যবসায়িক পণ্যের প্রচারণা করা হয় মাত্র। ইতোমধ্যে দিবসে দিবসে গোটা বছরের সবগুলো দিনকে ব্যবহার করা হয়ে গেছে। একই দিনে একাধিক দিবস পালনের কথাও শোনা যাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো শুরু হবে অর্ধদিবস পালন বা কোয়ার্টার দিবস পালন নিয়ে মাতামাতি। দিবস পালনে এত মাতামাতি না করে নির্দিষ্ট সমস্যা উত্তরণে সঠিক গবেষণা করা উচিত। একমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে মানব কল্যাণে সঠিক ও টেকসই ভূমিকা পালনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা সম্ভব।
এসব দিবস পালন করতে যে খরচ হচ্ছে সেই অর্থ যদি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে সামাজিক জরিপকৃত ফলাফলের মাধ্যমে সরাসারি অধিকারহারা মানুষগুলোর সেবায় কাজে লাগানো সম্ভব হতো তাহলেও কিছুটা উপকার হতো বলে বিশ্লেষকগণ মনে করেন। বিশেষ করে আমাদের দেশে দরিদ্র প্রান্তিক মানসিক রোগিদের ক্ষেত্রে গ্রামগঞ্জে কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠনিক কাঠমোযুক্ত চিকিৎসাব্যাবস্থা গড়ে উঠেনি। এমবিবিএস পড়ুয়াদেরকে মানসিক রোগের চিকিৎসক হতে চাও কি-না বিষয়ে প্রশ্ন করলে বলে, ‘পাগলের ডাক্তার হতে চাই না।’এমনকি ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে তাদের কোন কোন অভিভাবকগণও বলেন, ‘আমার সন্তানকে পাগল নিয়ে দিনরাত থাকতে দিতে চাই না। ওটা বাদ দিয়ে অন্যটা পড়।’অথচ, আমাদের দেশে মানসিক রোগীর হার প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য শতকরা ১৮ এবং শিশুদের মধ্যে ১৩ জন। দেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য মাত্র ৩৫০ জন ‘সাইকিয়াট্রিস্ট’ও ৫০০ জনের মতো ‘সাইকোলজিষ্ট’মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
আমাদের দেশে উচ্চডিগ্রীপ্রাপ্ত অনেক চিকিৎসকের মানসিক চিকিৎসা সম্পর্কে উদাসীনতা রয়েছে। এদেশে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানসিক চিকিৎসকগণ শুধু শহরে প্রাকটিস করতে ভালবাসেন। তা চলতে থাকলে প্রান্তিকজনদের মানসিক চিকিৎসা সেবার সুযোগহীনতা এবং অবৈজ্ঞানিক মানসিক চিকিৎসা নেবার প্রবণতা দিন দিন বাড়তে থাকবে। এই আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যবান্ধবহীন নীতি আমাদের দেশের মানসিক রোগির সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে একটি অসুস্থ সমাজের ব্যপকতা তৈরী করে ফেললে ভবিষ্যতে এর দায়ভার কে নেবে?

*প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.