-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
জুলাই ১৩, ২০২৪ সালের ভোর পাঁচটায় শুরু হয়েছিল এক তুমুল বৃষ্টি। রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ মানুষ তখনও গভীর ঘুমে। এ সময়টা ঘোর বর্ষাকাল। তাই ভারী বৃষ্টিপাত হতেই পারে। তাই এলার্ম শুনেও আরেকটু ঘুমিয়ে নিই বলে যারা কিছুটা দেরীতে উঠে অফিসে যাবেন বলে আটটার দিকে পথে নেমেছেন তাদের চক্ষু সেদিন চড়কগাছ। সকাল ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টি থামেনি। একটানা চার ঘন্টার মুসলধারার পতনে তিলোত্তমা ঢাকার ২৬ থেকে ৩০টি বড় রাস্তা একসংগে ডুবে গেছে। ভুক্তভুগীরা বলছেন এই ডোবা সেই ডোবা নয়! রাস্তায় ১-২ ঘন্টা জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকার পর অনেক গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে পড়ায় অচল হয়ে যানজট অসহনীয় করে তুলেছিল সেদিন। সংবাদে টেলিভিশনের ভিডিও চিত্র দেখে তাই মনে হচ্ছিল।
সে এক অতি ভয়ংকর অবস্থা সারা দিন জুড়ে। যেখানে চোখ যায় সেখানে মনে হয় প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। নটরডেম কলেজের পাশের রাস্তায় পার্কিং করা কারের শুধু ছাদটা দেখা যাচ্ছে। মালিক গাড়িতে উঠতে গিয়ে হতবাক হয়ে পড়েছেন। নিউমার্কেটের প্রধান গলিতে বুক সমান পানি। দোকান ,ালিকরা যারা বাসা থেকে ডুবন্ত নিউমার্কেটের ছবি দেখে দৌড়ে এস মাল সরানোর চেষ্টা করেছিলেন তারা অনেকে এসে দেখেন দোকানের তালা ঘোলা-ময়লা পানিতে ডুবে অচেনা হয়ে গেছে। মালপত্র ভিজে গছে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে পর্যন্ত সেই মালামাল সরাতে পারেননি। কোথায় নেবেন? বেরুনোর সব রাস্তায় থৈ থৈ পানি। ভ্যান, যানবাহন কিছুই ঢোকানো যাবে না! এখানে জলের যানবাহন নেই। কলের গাড়ি জমানো বৃষ্টির বুক সমান জলে চলার পথ খুঁজে পায়নি কোথাও।
গ্রীণ রোডে অনেকগুলো প্রাইভেট হাসপাতাল। সেখানে আগত রোগীদের অবস্থা খুবই করুণভাবে চিত্রিত হয়ে সংবাদে ঠাঁই নিয়েছে সেদিন। ডুবন্ত রিক্সাভ্যানে মহিলা রোগীকে শুইয়ে নিয়ে ঠেলে চলছেন রোগীর আত্মীয়-স্বজনেরা। পাশের ভবনের কৌতুহলী মানুষ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে আহারে বলে অনুভুতি প্রকাশ করেছেন। ভাগ্যিস শুক্রবার হওয়ায় সেদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল না।
এদিন পথে যারই নেমেছেন তারাই দুর্ভোগে পড়ে গিয়েছেন। বাইকারদের অনেকের ইঞ্জিনে পানি ঢুকে স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। পেটে ধান্ধায় যারা ব্যাটারীরিক্সা, সিএনজি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন তাদের বাহন অচল হয়ে যাওয়ায় সেগুলো ঠেলে অন্যত্র সরিয়ে নেবার কোন উপায় ছিল না। চিৎকার করে কেউ কেউ বলছিলেন, আমাদের ট্যাক্স, ভ্যাট আদায়ের সময় যারা নিয়ম দেখায়, যারা জরিমানা আদায় করে তারা এখন ঘরে বসে টিভিতে আমাদের কষ্ট দেখে তামাশা করছে! এই তিলোত্তমা নগরে নাগরিক সুবিধা কি সামান্য বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকবে?
কথা হলো- এই তিলোত্তমা কি দেবে তোমায় আমায়? তার কি-বা দেবার আছে? রাজধানী ঢাকাকে বিশেষণ দিয়ে রূপসীর টোল পড়া গালের তিলের সাথে তুলনা করা হয়। এর সৌন্দর্য্যরে মোহে কবি-সাহিত্যকরা কত শত ছড়া-কবিতা লিখেন দিনরাত। কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর কত মূল্যবান প্রসাধনী কিনে সাজানো চেষ্টা করেন এর দেহকে। এর একই অঙ্গে উত্তর-দক্ষিণে কত বাহারী আলো শোভা পায়। কিন্তু দিনমেষে এত মেকাপ রিমুভ করে ঘুমুতে যাবার উপায় নেই তার। এজন্য সে নিজেই নিজের সহ্যগুণ হারিয়ে ভালনেরাবল বা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেদিকে কারো কোন নজর নেই।
তবুও প্রতিদিন নতুন নতুন ফেসপাউডার, কাজল, ভারী ভারী গহনা পরানো হচ্ছে। তিলোত্তমার বুক চিরে এত ভারী গহনা পরানোর ফলে এর বুক দুরু দুরু করছে, কানের গহনা কখন কান ছিঁড়ে পড়বে তার নিরাপত্তা নেই। এর প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় এখন বন্ধ হয়ে গেছে! এসব কথা আক্ষেপ করে বলছিলন এক প্রবীণ ঢাকাবাসী। তাঁর কাছে তিলোত্তমা ঢাকার প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হবার কথা হঠাৎ আঁৎক উঠে জিজ্ঞাসা করলাম সেটা কেমন?
মানুষের প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হয়ে গেলে যদি দ্রæত চিকিৎসা করানো না যায় তাহলে মৃত্যু অনিবার্য। তবে তিলোত্তমা ঢাকার পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হলো কিভাবে? তিনি জানালেন, ধরুন এর বাতাসের মান বছরের দশমাসই অস্বাস্থ্যকর থাকে। পথে হাঁটতে গেলে নাক, চোখ দিয়ে গরম পানি ঝরে। এখন বর্ষাকাল তাই বায়ুতে একটা স্বস্থি। এর মুখ খোলা। কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, যা দিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ, ছাত্র, বেকার, ভাসমান মানুষ ঢুকছে। কেউ একবার ঢুকলে আর বের হতে চায় না।
তবে ভয়ংকর বিষয় হলো- এর নিচের ইন্দ্রিয় দুটো বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে। যেমন ধরুন ভূগর্ভস্থ সুয়্যারেজ লাইন ও নর্দমাগুলোর কথা। এই দুটি তিলোত্তমার অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয়। জুলাই ১৩, ২০২৪ তারিখ চার ঘন্টার বৃষ্টির পানি যদি বাধাহীনভাবে সকল নর্দমা দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়তো তাহলে কি এই ভয়ংকর জলজট হতো?
কিন্তু তিলোত্তমা ঢাকার অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় সদৃশ নর্দমাগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এর নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে এর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। তিলোত্তমা ঢাকার উন্নয়ন কাজে এত বেশী প্রতিষ্ঠান জড়িত তা গুনে শেষ করা যাবে না। তাদের মধ্যে কাজের সমন্বয় নেই। কে কখন কাটলো, কে ঢেকে রাখলো, আর কে নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিল তা ঠিকমতো হিসেব রাখার মতো সময় সুযোগ নেই কর্পোরেশনগুলোর।
সুতরাং একটু বৃষ্টি হলেই প্লাষ্টিক, মাটি, কাপড়ের টুকরো, কিচেন গার্বেজ ইত্যাদি দিয়ে এর নিচের ইন্দ্রিয় বা ময়লা নিষ্কাণের নর্দমা বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে। যার নেতিবাচক প্রভাব এসে পড়ে রাজপথে, অলিতে- গলিতে, বাড়িতে, মার্কেটে। নগরের সব জায়গার সব কার্যক্রম হঠাৎ থৈ থৈ পানিতে সয়লাব হয়ে যায়।
এজন্য কর্পোরেশনগুলোর সার্বক্ষণিক ওয়াচটিম ও মটিভেশন কর্মসূচি থাকা দরকার। একেকটি সার্বক্ষণিক ওয়াচটিমের এক-দুইজন সদস্য একেকটি এলাকার দশটি করে নর্দমার প্রবাহ ক্লিয়ার আছে কি-না তা ওয়াচে রাখলে এই জলাবদ্ধতা সহজেই নিরাময় করা যাবে! জাপানের ট্রাফিক যেমন অফিসে বসেই রাস্তার চলন্ত গাড়ি ওয়াচ করে মাসিক বেতন বিলের সাথে জরিমানার বিল কেটে ধরিয়ে দেয় তদ্রæপ আমাদের সিটি কর্পোরেশনের নর্দমা ওয়াচ টিমের দৈনন্দিন কার্যকলাপ সিসি ক্যামেরা ও ড্রোন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করে জরিমানার বিধান করা যেতে পারে।
তিলোত্তমা ঢাকার নির্মাণ কাজ সারা বছর জুড়ে চলে, কখনও শেষ হয়না। নির্মাতারা রাস্তার পার্শ্বে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী, নুড়ি পাথর বর্জ্য ফেলে স্তুপ করে রাখে। একটু বৃষ্টি হলে সেগুলো গড়িয়ে নিকটস্থ ড্রেন বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন পার্ক, পথঘাটের খোলা রেষ্টুরেন্টে হরদম পলিথিন প্যাকেটে খাদ্যসামগ্রী বিক্রি হয়।ফুটপাতের দোকান, দর্জিপাড়া ইত্যাদি থেকে প্লাষ্টিক ব্যাগ ও বেশী শক্ত বর্জ্য নর্দমার মধ্যে ফেলা হয়ে থাকে। ওয়াচটিমের মাধ্যমে সেগুলো নিয়মিত সরিয়ে ড্রেনের ময়লা পানির গতিপ্রবাহ দেখে প্রতিদিন রিপোর্ট নেয়ার নিয়ম থাকা উচিত।
হয়তো অনেক নিয়ম কানুন হাতে নেয়া হয়েছে। কিন্তু তিলোত্তমার রাস্তায় যত্রতত্র কাগজ, পলিথিন, ইটের টুকরা, আবর্জনার ছড়াছড়ি দেখে এসব কাজের অস্তিÍত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাইতো মনে হয় মাত্র একবেলা বৃষ্টির পানিতে কেন এই বন্যা! গেল অর্থবছরে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সাতশত পঞ্চাশ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে বলে একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছে। তবু কেন নগর জুড়ে ভয়াবহ জলাব্ধতার দুর্ভোগ কিছুদিন পর পর ঘাড়ে চাপে? এর দায়ভার কার?
তিলোত্তমা ঢাকা যানজট, জলজট ইত্যাদিতে নিজেই পঙ্গু হয়ে অসাড় হয়ে পড়েছে। বুয়েটের আবাসিকের মতো জায়গায় নগর পরিকল্পনাবিদদের কোয়ার্টারের নিচতলাবাসী এবার জলজটকে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তারা কেউ কেউ পাম্প দিয়ে ঘরের পানি সেচে বাইরে ফেলার চেষ্টা করেছেন। কেউ সারারাত ঘুমাতে পারেননি। তাদের জন্যও উন্নত নাগরিক সেবা সে রাতে শুণ্যের কোটায় নেমে গিয়েছিল।
তিলোত্তমা ঢাকায় প্রায় প্রতিবছর এই জায়গায় বার বার কাটাছেঁড়া করায় অতি উন্নয়নের ভারে সে নুব্জ্য হয়ে পড়েছে। যেমনটি ঘটেছিল পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসনের বেলায়। তাঁর দেহের বিভিন্ন অঙ্গে এত বেশী প্লাষ্টিক সার্জারী করা হয়েছিল যে তিনি একসময় চরম হতাশ হয়ে ওষুধ গ্রহণ ছেড়ে দিয়ে একা একা বাঁচার জন্য নিসঙ্গ: থাকতে চেয়েছেন। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। এখন থেকে আমাদের তিলোত্তমা ঢাকার অঙ্গে আর কাঁটাছেড়া না করাটাই উত্তম।
অসুস্থ তিলোত্তমার উপর একসংগে অনেক ব্যাধি ভর করেছে। এ অবস্থায় তার কাছে আর কি নতুন সেবা চাওয়ার আছে আমাদের? তাই তিলোত্তমার উপর আর শল্য চিকিৎসা না চাপিয়ে উল্লিখিত টোট্কা দাওয়াই দিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর আছে বলে মনে হয় না।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]