–প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
আশির দশকের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে আমরা ঘুমাতে পারতাম না। ক’দিন পর পর পুলিশি রেইড হতো। ভোররাতে হাজার হাজার পুলিশ, বিডিআর হলপাড়া ঘিরে দম্ভ করে হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দিত- নিচে নেমে আসুন। দ্রুত হল ত্যাগ করে চলে যান। ছাত্ররা হৈচৈ করে ছাদে উঠে সামরিক সরকারের পুলিশের দিকে ঢিল ছুঁড়তো। নামতে না চাইলে টিয়ার সেল ছুঁড়ে চারদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে, গুলি করে আতঙ্ক তৈরী করে একসময় কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যেত। হল খালি করে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হতো। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিলে তাদের ক্ষমতা থাকা নিরাপদ হয়ে উঠতো।
শিক্ষার্থীরা সেসময় সামরিক সরকারকে মোটেও পছন্দ করতো না। জনগণ আরো পছন্দ করতো না। সেটা সেই সরকার জানতো। কিন্তু জেনেও বার বার হামলে পড়তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এবং বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে শুরু হওয়া আন্দোলন দিয়েই দ্রæত সামরিক সরকারের পতন হয়েছিল।
এবছর ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া যৌক্তিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আঠারো দিন পার হয়ে গেল। এর মধ্যে কতকিছু ঘটে গেল এবং যাচ্ছে সেট প্রযুক্তির কল্যাণে দেশ-বিদেশের সকল সচেতন মানুষ অবগত আছেন। ক্ষুদ্র একটি আন্দোলন কিভাবে তিলে তিলে তাল হয়ে গেল তা জনগণ অপলক নয়নে দেখছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কথার মাধ্যমে বীজ থেকে বটগাছে পরিণত করার জন্য দায়ী যিনি বা যারা তাদেরকে আড়াল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো দায়িত্বশীল একটি দম্ভকারী গ্রুপ। তারা অবহেলা, অতিকথন, বালখিল্যতা দিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে ক্ষেপিয়ে তুললো। সেটা বুঝেও না বোঝার ভান করে শিক্ষার্থীসহ দেশের আপামর নিরীহ জনগণকে কেন আরো বেশী ক্ষেপানো হচ্ছে- সেটাও অনেকের নিকট গভীর প্রশ্নের উদ্রেক করছে।
কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিলে পড়াশুনা, গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়। নৈতিক চেতনা ঝিমিয়ি পড়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার মগজগুলোকে দমিয়ে রেখে রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও দুর্নীতিতে আড়াল করা সহজ হয়। দুর্বলদের পক্ষে হক কথা বলাটা সহ্য করে না স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর দুষ্টু মানুষেরা। যুগে যুগে বিভিন্ন সমাজে এটাই ঘটে। তাইতো ডিজিটাল সভ্যতার যুগে এসেও ইউরোপ, আমোরিকায় ছাত্র আন্দোলন দমন করা হচ্ছে। কিন্তু সেটা পেরিয়ে আমাদের সবুজ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে। তবে আমাদের ঢেউয়ের আছাড়টা ওদের চেয়ে একটু বেশী হয়ে সুনামী গেছে। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে হঠাৎ করে স্কুল কলেজ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে!
এটা খুবই মারাত্মক। একটি দেশের সকল শিক্ষাঙ্গন একযোগে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে- মনে হয় এই ধরনের সর্বাত্মক ছুটি এটাই প্রথম। কিন্তু কেন এটা করা হলো? ইসরায়েলের মতো কেউ কি এদেশে বোমা ফেলতে চেয়েছিল? নাকি কোন বৈদেশিক শক্তি আক্রমণের ভয় দেখিয়েছে? দেশে কি কোন সেরকম যুদ্ধ বা অভ্যন্তরীণ অর্ন্তদ্ব›দ্ব লেগেছে? শেষেরটা যদি সত্যি মনে করা হয় তাহলে কি বা কার কারণে সেট শুরু হলো- সেটাও দ্রুত খতিয়ে দেখা দরকার।
এটা শুরু হবার আঠারো দির পরে একটি সংহিস আন্দোলনে পৌঁছে গেল কার সুবাদে? সেটা এখন বড় চিন্তার বিষয়। জনগণের কষ্টের কথা বলে এই আন্দোলনকে ভিন্নদিকে সরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু কষ্ট হলেও জনগণ সেই আনোদলনকে মেনে নিয়ে একাত্মতা প্রকাশ করছেন। জনগণ কিছু লোভীদের কপটতা, উন্নাসিকতা ইত্যাদি ধরে ফেলেছে। ফলে নিজেদের অনুভূতি ও বিবেক থেকে এটাকে মেনে নিয়েছে। এমনকি কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে আন্দোলনে শরিক হয়েছে।
তারা ‘বাংলা ব্লকেড’ থেকে ‘কমপ্লিট ব্লকেড’শুরু করে আর কি কি আন্দোলন করতে থাকবে তা এই মুহূর্তে বলা মুষ্কিল। কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবহার করে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করার কথা বার বার বলা হচ্ছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিটি কেন এত বড় করার সুযোগ দেয়া হলো বা এখনও সুযোগ দেয়া হচ্ছে তা মোটেই বোধগম্য নয়। এদিকে ১৭-১৮ জুলাই বিভিন্ন বাহিনীর মাধ্যমে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর শক্তি প্রদর্শণের মাধ্যমে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, বেগম রোকেয়াসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আন্দোলন দমন করার প্রচেষ্টায় যে ক্ষতি হয়েছে তা মেনে নেয়া কষ্টকর।
কর্তৃপক্ষকে উন্নাসিকতার সুরে বলতে শোনা গেছে- ‘আন্দোলন করে করে ওরা ক্লান্ত হোক তখন দেখা যাবে।’ এভাবে সরকারের তরফ থেকে দীর্ঘদিন এই আন্দোলনকে গুরুত্ব না দেয়ায় যে বিভ্রান্তি ও ভুল বুঝাবুঝি পারস্পরিক আলাপ আলোচনায় না গিয়ে শুধু হম্বিতম্বি ও দৈহিক শক্তি প্রদর্শণ করাটা সবার জন্যই চরম ক্ষতিকর। বিভিন্ন অপবাদ শুনে বাচ্চাদের অভিমান, বুকে কষ্টের শিখা বেড়ে যাবার আন্দোলনকে যদি কেউ ভিন্ন পন্থায় বা সামরিক শক্তি প্রদর্শণের মাধ্যমে দমন করার চেষ্টা চালাতে থাকে তাহলে সেটা চরম ভুল হবে।
এই অসম লড়াই দেশের মধ্যে ভেদাভেদ আরো বৃদ্ধি করবে এবং সামাজিক ভাঙ্গনকে গভীর করে তুলবে। তাই আদালতের দোহাই দিয়ে কালক্ষেপণ করে আলোচনায় বসা যতই প্রলম্বিত হবে ততই দেশের জন্য অমঙ্গল বয়ে আনতে থাকবে এবং দুর্নীতিবাজ, মেগা-জালিয়াত, সুবিধাবাদীরা এর সুযোগ গ্রহণে চেষ্টা করবে এমনকি পানি বেশী ঘোলা হয়ে গেলে এটা বৈদেশিক আগ্রাসনকে আমন্ত্রণ করতে থাবে ।
দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বেশী। বলা হয়, প্রায় দশ-বারো কোটি মানুষ এখন স্মার্ট মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারে। এটা তাদের আর্থিক উন্নতির সাথে নৈতিক উন্নতি ঘটাতে সহায়তা করছে। তারা মোবাইলের সুবাদে আত্মসচেতনতাবোধ থেকে নিজে এবং সমষ্টিগত প্লাটফরম থেকে অন্যায়কে অন্যায় বলতে শিখছে। ফলে শুধু কয়েকটি পোষা টিভি চ্যানেলে বিবৃতি দিয়ে তাদেরকে অবহেলা, বঞ্চনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা কঠিন। নানা উদাহরণে ‘আরব বসন্ত’-র কথা বলা হয়- কিন্তু কোটা আন্দোলন নিয়ে আমাদের দেশে ‘বাংলা বসন্ত’সূচিত হচ্ছে সেটা কি কেউ মাথায় রেখেছেন?
দীর্ঘদিন দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখাটা আমাদের জন্য শাঁখের করাত স্বরুপ। কারণ এভাবে শিক্ষাসঙ্কোচন করলে আমাদের স্বকীয়তা ও জাতীয় মর্যাদা গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হতেই থাকবে। সুযোগ ও সক্ষমতা আছে বলেই সাধারণ রঙ্গ-ব্যঙ্গ, অভিমান ইত্যাদিকে আমলে না নিয়ে কাউকে শূলে চড়ানোর তৎপরতা খুবই বোকামি। শিক্ষার্থীদের একটি যৌক্তিক আন্দোলনকে গুরুত্ব না দিয়ে- ‘এটা ফেসবুকের দোষ’বলে উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করাটাও চরম বোকামি।
সাধারণত: সামরিক সরকারকে জনগণের পালস্ বুঝতে দয়ে না তার আশেপাশের চাটুকাররা। তারা পানি পানি বেশী ঘোলা করে নিজেদের সুবিধা আদায় করতে বেশ তৎপর থাকে। কোন অঘটন আঁচ করলে বিদেশে পালিয়ে আত্মগোপন করতেও বেশ পটু। কিন্তু একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারের দাবীদারকে সেই পরিস্থিতিতে পড়তে হবে কেন? জনগণের পালস্ বুঝেও সেটা বুঝেও না বোঝার চেষ্টা করা বা শক্তি দেখানো বিপজ্জনক-সেটা গত কয়েকদিনের ঘটনায় অতি নেতিবাচকভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। যা দেশ ও জনগণ উভয়ের জন্যই অকল্যাণকর। সাধারণ মানুষ এই কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে, অনেক মুক্তিযোদ্ধারাও এর পক্ষে, তবুও আলোচনায় এত দেরী কেন?
*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।