মঙ্গলবার | ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ২ আশ্বিন, ১৪৩১

চতুর বেজি ও দুর্নীতি সাপের ক্ষমতানুপাত

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম

বেশ কিছুদিন আগে উপকারী ও ক্ষতিকর কিছু প্রাণির নাম উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় আলোচনা শুরু হয়েছিল। সে আলোচনার ঢেউ সবকিছু ছাড়িয়ে মহান সংসদের তাপানুকুল কক্ষেও উত্তাপ ছড়াতে দেরী করেনি। সেদিন একজন তরুণ সাংসদ তার সংসদীয় মাইকে অগ্নিঝরা বক্তব্যে নানা সমস্যার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘…রাসেল ভাইপার সাপ চলে আসছে মাননীয় স্পীকার.. কিন্তু সেই পরিমাণ বেজি নাই।’প্রসঙ্গত, আমাদের সমাজে সাপের উৎপাত বেড়ে গেছে কিন্তু সেই অনুযায়ী বেজির তৎপরতা নেই। আসলে কি তাই?

হয়তোবা তাই হবে। একদিন আগে দুপুরবেলা ঝুম বৃষ্টির একটানা মাধুর্য্যে দোতলার বারান্দায় বসে বাগানের নুয়ে পড়া সব্জিগাছগুলোর দিকে বার বার তাকাচ্ছিলাম। কাছেই কিছু পাখি বেশ চেঁচামেচি করছিল। ঢেঁড়শবেডের ঘন সবুজ গাছের নিচে কি যেন ঘোঁৎ ঘোৎঁ করে নড়াচড়া করছে। একটু ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম দুটো বেজি সেখানে নিজেকে লুকিয়ে কি যেন খুঁজছে। ওরা নিচের বারান্দায় বিড়ালের জন্য পাত্রে রাখা খাবারে মাঝে মাঝে ভাগ বসাতে আসে। তবে সেটা রাতের বেলা।

ক’দিন ধরে একটানা বৃষ্টি চলায় আশেপাশের জঙ্গলে পানি জমে গেছে। খাবারের অভাব ঘটায় হয়তো আজ দিনের বেলা বাগানে ঢুকে পড়েছে। হঠাৎ বেজি দেখে মনে করলাম থাক্, ওরা বেশ উপকারী প্রাণি। বেজি থাকলে সে এলাকায় সাপ আসতে চায় না। বেজিকে সাপেরা খুব ভয় পায়। সাপে-নেউলে সম্পর্কটা কখনই মধুর নয়।

তবে বেজির আনাগোনা না থাকলে সাপেরা নির্ভয়ে সেখানে বিচরণ করার সাহস পায়। আর বেজি থাকলে গোপনে বিচরণ করে, দেখামাত্র সাপ দৌড়ে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করে থাকে। সাপ বেজিকে সহজে কামড়াতে পারে না।

তবে আজকাল কি-যেন হয়েছে! বেজি সাপ একই এলাকায় সদর্পে বাস করে। কেউ কাউকে তাড়া করে না। উভয়কেই বেশ তাজা ও শক্তিশালী চেহারায় একত্রে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। যা মানুষ অথবা অন্যান্য নিরীহ প্রাণির জন্য সুখকর নয়। যেটাকে বলা যায়- আসল চরিত্রের বেজিরা কমে গেছে অথবা দৃশ্যত নেই! সেটাই হয়েতো মানুষরুপী বেজি ও সাপের উপমা দিয়ে বলতে চাচ্ছিলেন সেই তরুণ সাংসদ।

গত কয়েক মাস ধরে রাসেল ভাইপারস্ আক্রমণে সারা দেশে অনেক মানুষ হতাহত হয়েছেন। এজন্য চরম আতঙ্ক ছড়িয়েছে জনমনে। রাসেল ভাইপারস্ নিয়ে সব ধরনের গণমাধ্যমে প্রচারণা চলছে। কেউ কেউ সম্প্রতি দেশের সীমান্ত ভেদ করে ভারতের সাথে নানা দিক দিয়ে ট্রেন চলাচলের সমঝোতা স্মারককে উদ্দেশ্য করে বৈদেশিক রাসেল ভাইপার আগমনের ভয়ংকর রুট হিসেবে আগাম সতর্কবাণী হিসেবে প্রচার করতে তৎপর রয়েছেন।

ভবিষ্যতের বিদেশী রেলগাড়িগুলোকে ভয়ংকর সাপগাড়ি দেখিয়ে প্রচারণায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন অনেকে। তারা মনে করছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো সীমান্ত চলাচলে ততটা উদার ও সভ্য হয়নি উপমহাদেশের মানুষ। কারণ সেসব দেশ পরস্পরকে সমমর্যাদায় সমীহ করে। তারা সীমান্তে পশু-পণ্য পাচার নিয়ে কেউ পাহারা বসানোর প্রয়োজন মনে করে না, নিরীহ মানুষকে পাখির মতো হত্যা করে না। তারা আঞ্চলিক ট্রানজিট দিয়ে নিজেদের পর্যটন, ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসারের মাধ্যমে সবাই সমভাবে আয় করে। আমরা ট্রানজিটের নামে আসলে করিডোর খুলে একচেটিয়া লাভ করতে দিয়ে নিজ নিরাপত্তা ক্ষুন্ন করেছি। তাই রাসেলস্ ভাইপারের মতো সমঝোতা স্মারকের ভূ-রাজনৈতিক তাপর্য্য কোন ফেলনা বিষয় নয়।

আমাদের নদীতীরবর্তী জেলা ও এর চরাঞ্চলে যে বিষধর রাসেল ভাইপারের আক্রমণ শুরু হয়েছে এদের বিষ-ক্ষমতা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট থেকে তথ্য পেশ করে মটিভেশন চালানো হচ্ছে। কেউ কেউ পৌরাণিক  কাহিনী জুড়ে দিয়ে বলছেন- রাসেল ভাইপার মেরে ফেললে মানুষের বাচ্চারাও বেঁচে থাকবে না। কেউ বলছেন এই সাপ কাটলে রোগীকে ওঝার কাছে নিয়ে কালক্ষেপণ করা উচিত নয়। বরং রোগীকে দ্রুত হাপাতালে সঠিক ভেনম ইঞ্জেক্ট করতে পারলে ৭০ ভাগ মানুষ বেঁচে যায়। তবুও অনেকেই এই সাপ মারার জন্য জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন।

তবে হ্যাঁ, জীববৈচিত্র রক্ষা করতে হলে নির্বিচারে কোন প্রাণি নিধন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কৃষি জমিতে ব্যাঙ, সাপ না থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে পোকামাকড় ও ইঁদুরের দৌরাত্ম্য বেড়ে গিয়ে মানুষের জন্য শস্যকণা অবশিষ্ট থাকবে না। এমনকি ফসলের অভাবে দুর্র্ভিক্ষও শুরু হয়ে যেতে পারে। যতই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া চালাই না কেন প্রাকৃতিক ভারসাম্য না থাকলে ক্ষতি অনিবার্য।

সাধারণত: বেজি-শিয়াল মানুষকে দেখলে নিজেরাই পালায়। এদেরকে মানুষ সচরাচর ভয় পায় না। কোন কারণে বেজি-শিয়াল মানুষকে কামড়ালে কামড়ায় হাঁটুর নিচে। আর বাঘ দেখে মানুষ নার্ভাস হয়ে পড়ে। কারণ বাঘে ধরলে বা ঘা মারলে আর রক্ষা নেই। বাঘ মানুষের মাংস-কলিজা ভক্ষণ করে। সেখানেই বাঘে-মানুষের শত্রুতার ভয়াবহতা। সেজন্য বাঘের ভয়ে মানুষ লৌহ বেষ্টনী বানিয়ে রাখে অথবা চলার পথে গহীন বাঘাবন এড়িয়ে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে বাঁচতে চায়।

এভাইে গড়ে উঠেছে সভ্যতার বৈচিত্র্য। প্রাচীন সভ্যতা, মধ্যযুগীয় সভ্যতা, আধুনিক সভ্যতা পেরিয়ে মানুষ এখন অত্যাধুনিক সভ্যতার ধ্বজাধারী। আজকাল নেটওয়ার্কের চমকপ্রদ গতিতে মানব সভ্যতার বিকাশ এক অজানা অধ্যায়ে নিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছে। মানুষ নিজেকে সেই গতির সাথে তাল মেলাতে না পেরে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারস্থ হয়ে আরো সভ্য হবার চেষ্টায় তৎপর। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পর আরো কি ঘটতে যাচ্ছে সেটা অনেকে কল্পনাও করতে পারছেন না।

কিছুদিন আগে একটি কোরবানির খাসী ক্রয় ও সামাজিক নেটওয়ার্কে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া উপাখ্যান মানুষের জীবনপ্রণালীকে কতটুকু ভয়ংকর করে তুলেছিল তা অনেকই জানেন। মানুষ অনলাইনের সুবাদে সেই ভয়ংকর অবস্থার কথা দ্রুত জেনে ফেললেও সেটার কার্যকরী সমাধান অতিদ্রুত জানতে পারবে কিভাবে? আমাদের সমাজে চোর ও তাদের থাপইতদের বিচরণ আরো ভয়ংকর। থাপইতরা বা মাফিয়া ডনরা আড়ালে বসে চোরদেরকে চালায়। সেজন্য চোরেরা কোনকিছুকে ভয় পায় না। চতুর বেজি ও তাদের চতুর প্রভুরা অনেকাংশেই জ্ঞানপাপী। তাদের অনৈতিক চরিত্র ও রাক্ষুসে আচরণের কারণে মানব সভ্যতার বিনাশ ঘটে দিকে দিকে, সবসময়।

সেজন্য পৃথিবীতে ঠান্ডা যুদ্ধ থামানো যায় না। গরম যুদ্ধ কমলেও দেশে দেশে সীমান্ত হত্যা কোথাও বন্ধ হয় না। মানুষ প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়ায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে। ইউক্রেন, ফিলিস্তিন ইত্যাদি যুদ্ধ কখন থামবে তা কেউ জানে না। ইউএস-মেক্সিকো সীমান্ত, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত হত্যা। ক্রমাগতই ঘটে চলেছে নিরীহ মানুষ হত্যা। তার ওপর দেশ ছেড়ে তিউনিশিয়া, লিবিয়া হয়ে নৌকায় উত্তাল ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢুকতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করছে কত বাবা-মায়ের শত শত, হাজারো ধনীর দুলালেরা। এর সঠিক পরিসংখ্যানও অনেক সময় প্রকাশ করা হয় না। দেশে দেশে মানবপাচারকারী বিষাক্ত সাপেরা যেমন সক্রিয় তাদেরকে ঠেকানোর জন্য উপকারী বেজি সদৃশ চৌকষ গোয়েন্দা, সীমান্ত রক্ষী, নৌপুলিশ, রয়্যাল নৌবাহিনী, সাইবার পুলিশ ইত্যাদি তৎপর রয়েছেন বিভিন্ন মাঠে ঘাটে। এদের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। তবুও প্রতিদিন ঘটছে ভয়ঙ্কর রকমের অঘটন।

আমাদের দেশে অপরাধীর সংখ্যা নির্মূল হয়ে গেছে বলে যেসব বক্তব্য শোনা যায় তার সাথে নিত্য সংঘঠিত অপরাধের মাত্রাবিচারে সঠিক বলে ধরে নেয়া যায় না। অপরাধ নির্মূল হয়েছে- এমন বক্তব্য অপরাধীকে আরো বেশী উৎসাহী করে অপরাধ করার জেদ ও ভয়াবহতা উস্কে দেবার শামিল।

কারণ, মানুষ একটু সুযোগ পেলে পুন:অপরাধ করতে প্রবৃত্ত হয়। তার পেছনে সবসময় কুমন্ত্রণা দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে আরেকজন। এসব কুমন্ত্রণা থেকে কুপ্রবৃত্তির জাগরণ ঘটে অতি সহজেই। তারা এতটাই তৎপর থেকে কুপ্ররোচনা দেয় যেজন্য সমাজ থেকে অপরাধ কখনই শতভাগ নির্মূল করা যায় না। শুধু অপরাধের মাত্র কমানো যায় মাত্র। এজন্য প্রয়োজন হারমোনি বা সামঞ্জস্য বিধান করে চলা।

তবে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য শুধু বেজির সংখ্যা বাড়ালেই কাজ হয় না। সাপ ধরা বেজির সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সঠিক ও কার্যকর প্রশিক্ষণধারীর সংখ্যানুপাত: বেড়েছে কি-না তা পর্যবেক্ষণ করা উচিত। আধুনিক যুগে সংখ্যা নয়- সৎ ও নৈতিকতাসম্পন্ন মেধার মাধ্যমে টেকসই সফলতা আসে। আমাদের সমাজে এটার ঘাটতি আছে। এর ঘাটতি পূরণে তাই আজকাল মহান সংসদে কিছু তরুণরা সোচ্চার। এধরনের আলোচনাগুলো জাতিকে অনেকটা ভরসা দেয়।

তবে মজার ব্যাপার হলো- বেজি পুষিয়ে, তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে, সাপ ধরার জিরো টলারেন্স তৎপরতা দেখিয়ে যদি ঘরের বেড়ায় সজ্ঞানে ছিদ্র তৈরী করে রাখা হয় তাহলে ঘরের মালিক ও বাসিন্দাদের কি বিপদ ঘটতে পারে সেটা গভীরভাবে আঁচ করার সক্ষমতা কি আমাদের আছে?

কারণটা শুধু আমাদের দেশে নয়, উপমহাদেশে মানুষের স্বপ্নের সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের লালনের বৈপরিত্য চলছে। সেজন্য ঐতিহাসিকভাবে লক্ষ্যণীয় যে, বর্গীরা এখানে বহুবার হামলা করেছিল এবং এখনও বার বার হামলে পড়তে উদ্যত হচ্ছে। এখন চলছে পারস্পরিক আস্থাহীনতায় জাতি বিভাজনের অস্থির রাজনীতি। তার সাথে কিছু দুর্নীতিবাজ রাজকর্মচারী হাম্বরা বুলি দিয়ে রাজা-বাদশার মতো আচরণ করে চরম সামাজিক অস্থিরতা তৈরী করে চলেছে- যার লঘু অনুপাত সহ্যণীয় কিন্তু মিশ্র ক্ষমতাণুপাত একটি গণতান্ত্রিক সমাজে অচল, অগ্রহণীয়। ফলে সাধারণ মানুষের চেয়ে দুর্নীতিবাজদের বেশী উন্নতি হয়েছে। তারা নিজের ভ্রমে বা লোভের বশবর্তী হয়ে সজ্ঞানে যেন ছিদ্র তৈরী করে বিপদকে আরোবেশী আহবান করতে না পারে সেটাই হবে আসল বেজিপোষার মতো প্রতিরোধক।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীনE-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.