শনিবার | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১

টিভিতে ওই কয়জনকে দেখলে মানুষ ফুঁসে উঠছে!

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম

কোট আন্দোলন যারা শুরু করেছিল তারা ভাবতেও পারেনি মাত্র এ সপ্তাহ পর বা পরবর্তী একমাসের মধ্যে দেশে কি ঘটতে পারে। তারা এখন হিরো। কোটা আন্দোলনকে কেউ কেউ হঠাৎ হাইজ্যাক করে রাজনীতিকরণ করার অপবাদ দেয়া হলেও সেটা তার চেয়ে হাজার গুণ বেশী ধারণা লাভ করে ভিন্নরূপে বিকশিত হয়ে পড়েছে। সেটা আগষ্টের প্রথম সপ্তাহ না পেরুতেই দেশের সাধারণ জনগণের আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এটা এখন আর কোন রাজনৈতিক বেড়াজালের মধ্যে আবদ্ধ আন্দোলন নয়।

ক্ষমতাসীন দলের একজন বড় নেতার সন্তান বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া, আরেকজন স্কুলে পড়ে। তারা দু’জনই বাবা-মায়ের অনুমতির তোয়াক্কা না করে কোটা আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে রাস্তায় নেমে গেছে। একজন সাবেক মন্ত্রীকেতো সেদিন এক অনুষ্ঠানে দেখে তার ছেলের ব্যাপারে কোটা আন্দোলনের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন পোষ্ট দেয়ার ব্যাপারে অভিযোগ তোলা হয়েছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়–য়া ছোট ভাই তার বড় ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে হঠাৎ মর্মাহত হয়ে কোটা আন্দোলনের বড় সমর্থক সেজে রাজপথের মিছিলে গেছে তার দু:খী বাবা-মায়ের সাথে।

কিশোর হকারের গুলিবিদ্ধ লাশ দেখে তার সকল বন্ধু, স্বজন, এলাকার মানুষ, রিক্সাচালক, শ্রমিক পথে নেমে গেছে মিছিল নিয়ে। তারা অনেকই জানেন না, কোটা আন্দোলন কি এবং সেটা কার কল্যাণের জন্য কি বয়ে আনবে! গ্রামগঞ্জের মানুষ তার এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া মেধাবী শিক্ষার্থীর লাশের জানাজা পড়তে গিয়ে রাগে-ক্ষোভে ফুঁসে উঠে বাঁশের টুকরা হতে নিয়ে লুঙ্গি পরে নিকটস্থ শহরে দৌড়াতে দৌড়াতে মিছিলে জড়ো হয়েছে। সারা দেশে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষার্থী এই আন্দোলনে শরিক হবার জন্য একপায়ে খাড়া হয়ে উঠেছে।

আগষ্ট ০২, ২০২৪ শুক্রবারে জুম্মা নামাজের আগে মোটেও মনে হয়নি আজ বিকেলে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ একসংগে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে ঘৃণা প্রকাশ করবে! এদিন সাধারণ মানুষের হুঙ্কার বারুদের মতো ছড়িয়ে গেছে শত শত কচিপ্রাণের হত্যাকারীদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবী নিয়ে। এটা এক বিস্ময়কর অবস্থা। এই আন্দোলনের হাত বদল হয়ে গেছে নির্যাতিত মানুষের কন্ঠের মধ্যে একাকার হয়ে। সবাই শিক্ষার্থীসহ সকল নিষ্পাপ শিশু-কিশোর ও নিরীহ মানুষের হত্যাকারীদের বিচার চায়।

তবে তারা সেদিন আর সরকারের কাছে এই বিচারের দাবী করেনি। কেউ কেউ জাতিসংঘের কাছে এই বিচারের দাবী জানিয়েছে। তাদের ক্ষোভ ঝেড়েছে যারা এই হত্যা ঘটনার উস্কানীদাতা-দাত্রী। যারা পুলিশসহ আইনশৃংখলা বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছে হার্ডলাইনে গিয়ে এই স্বত:স্ফুর্ত আন্দোলনকে দমন করতে। যারা গুলির হুকুম দিয়ে, আন্দোলনকারীদেরকে হত্যাকরে  বেহায়া, নির্লজ্জের মতো বুকে কালো ফিতা বেঁধে শোকপালন করছে, শোকরানা আদায়ে মসজিদে দোয়া আয়োজন করছে অথবা শোক মিছিল করছে তাদেরকে ধিক্কার জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছে শোকাহত পরিবারগুলোর সদস্যরা, তাদের স্বজনেরা।

এই ধরনের শোক পালন করাকে তারা প্রহসন ও চরম নিষ্ঠুরতা মনে করে অভিশাপ দিচ্ছে। এসব নিষ্ঠুর ঘটনায় দেশের মানুষ বিগড়ে গিয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে ফেটে পড়লেও এক শ্রেণির নিয়ন্ত্রিত ও পোষা গণমাধ্যম এসব গণদাবীকে এডিট করে তাদের প্রভুদের ক্ষমতা টিকে রাখার জন্য বার বার একই কায়দায় প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা মানুষের মৃত্যুসংখ্যাও চুরি করেছে। আন্দোলনের সমন্বয়কারী কোমলমতিদের বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে জোরজবরদস্তি করে স্বীকারোক্তি আদায় করে গণমাধ্যমে প্রচার করেছে। ইন্টারনেট বন্ধ রেখে ব্যবসায়ী, সফটওয়্যার তৈরী প্রতিষ্ঠান ও গণদাবীর মুখে খুলে দিলেও সেটাকে বিভিন্ন জায়গায় শ্লথ করে রাখা হয়েছে। কিন্তু তাতেও সাধারণ নির্যাতিত মানুষ দমে যাচ্ছে না।

কোটা আন্দোলনকে ঘিরে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ঘটনাকে অন্যদিকে ঘুরানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে বলা হলেও ক্ষমতাসীনরা সেটা অস্বীকার  করেছেন। কিন্তু ০২ আগষ্ট থেকে রাস্তার মিছিলের বাস্তবতা ভিন্ন। সেখানে সব দলের সব মতের মানুষ জড়ো হয়েছেন। ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স, ছাত্র-ছাত্রী, শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ, শ্রমিক সবাই একদাবী তুলেছেন। বাড়িতে বিছানায় শুয়ে অসুস্থ দাদা-দাদী তার নাতি-নাতিনীকে বলছেন ‘তোর মোবাইলে আন্দোলনের ভিডিওটা একটু দেখাওতোরে’।

এই আন্দোলন এখন সবার। একটি মাত্র শব্দ বা বাক্যের মাধ্যমে জনমনে আঘাত করে এই আন্দোলনে ঘি ঢেলে দেয়া হলেও এখন সেই একটিমাত্র শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করে এই আন্দোলনকে থামানোর কোন উপায় নেই বলে মনে হচ্ছে।

এদিকে প্রতিদিন নতুন নতুন অভিধা ও শ্লোগান নিয়ে নতুন গতিতে আন্দোলনকে গতিবেগ দেয়া হচ্ছে। সেসব কর্মসূচি নির্যাতিত মানুষেকে সান্তনা দিতে কোটি মানুষকে আকর্ষণ করে শামিল হতে প্রেরণা যোগাচ্ছে।

তদুপরি, শিক্ষার্থীদের সাথে বা শিক্ষক-আন্দোলনকারীদের সাথে কর্তৃপক্ষের কারোই আলোচনার টেবিলে বসার নামগন্ধ নেই। তারা পুলিশি নির্যাতনের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করার নতুন কৌশল নিতে বিভোর হয়ে আছেন। যেটা কদিন আগে একবার বুমেরাং হয়েছিল সেটা আবারো বেশী গতিতে বুমেরাং হতে যাচ্ছে সেকথা জেনেও না বুঝার ভান করে দিনাতিপাত করছেন। আইনের ভয় দেখানোর কথা জনগণ আর শুনতে চায় না। যার প্রমাণ বেরোবি-র শহীদ আবু সাঈদের মতো বুক পেতে বুলেটে ঝাঁঝড়া হয়ে শত শত কচিপ্রাণের অকাল মৃত্যুবরণ। ব্যাপারটা এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে, ‘যত ক্ষমা চায় তত রাগ বাড়ে’-এমন খারাপ পরিস্থিতি।

যেসব নেতাদের স্টেরিওটাইপ বক্তব্য শুনলে মানুষ বিগড়ে যায় তাদেরকে বার বার টিভি পর্দায় দেখামাত্র মানুষের মেজাজ আরো বেশী খারাপ হচ্ছে এবং সরকারের জনপ্রিয়তা শুণ্যের কোটায় নেমে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে কারো ভ্রæক্ষেপ নেই। এটা যেন, ‘রোম পুড়লেও নিরোর বাঁশি বাজানো’ থেমে নেই। বিভ্রান্তি কোনভাবেই কমছে না। সরকার এখন যা বলতে যাচ্ছে, তাতেই বিরক্ত হয়ে ভুল খুঁজে পাচ্ছে জনগণ!

পথের আন্দোলনের সাথে প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ, পেশাজীবিদের একাত্মতার কথা শোনা যাচ্ছে। সেখানে আরো কোন নৃশংসতা ঘটানো হলে সেটা জাতির ভবিষ্যৎ জীবনে আরো বড় কলঙ্ক বয়ে আনতে পারে। কে বা কারা এই সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী তা গায়ে না লাগিয়ে জনতার দাবীকে উপেক্ষা করে আরো মারমুখী আচরণ প্রদর্শন করা শুধু অকল্যাণের পথকে প্রশস্থ করতে থাকবে। এই সংকট জিইয়ে রাখার চেষ্টা করলে সেটা আরো বেশী ঘণীভূত হয়ে এতদিনের যা কিছু অর্জন ছিল তা সমূলে ডুবিয়ে দেবে।

মৃত্যুর উপরে আর কি বড় কোন শাস্তি আছে? বিনা কারণে হঠাৎ পিতাহারা সন্তান বা সন্তান হারা পিতামাতা সম্বলিত পরিবারগুলোর মর্মবেদনা শুনে কোন পাষাণ হৃদয় কেন বিগলিত হবে না? এই মুহূর্তে মানুষের মনের অভিব্যক্তির সাথে বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি রাস্তার মিছিলের সাথে একাকার হয়ে গেছে। মনের ক্ষোভ মেটাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে আক্ষেপ ঝাড়তে দ্বিধা করছে না। শত শত প্রাণের হত্যকান্ড ঘটানোর পর মানুষের কষ্ট ও বেদনা মেটানোর জন্য প্রতিষেধক ব্যবস্থা না নিয়ে এখনও উপহাস চলছে, চলছে নিশিরাতে বাড়ি বাড়ি রেইড।

এসবকিছুই কাঁটাঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে আঘাত করার মতো ওদের জঘন্য গা বাঁচানো কৌশল। তাদের কেউ কেউ বলছেন- টিভিতে ওই কয়জনকে দেখলে আমার খালি বুকটা বেদনায় হাহাকার করে উঠে, ওদের মতো পাষাণদেরকে আর সামনে দেখতে চাই না। এভাবেই দিকে দিকে ফুঁসে উঠছে কোটি জনতা। শুরু করেছে সর্বাত্মক অসহযোগের মতো কঠিন আন্দোলন। ইতোমধ্যে ৩১টি সংগঠন সরকারের পদত্যাগের দাবী তুলেছে!

এভাবে নিহত পরিবারের নির্যাতিত, আহত মানুষের আর্তনাদ হাহাকার বিচার না পেয়ে চরম অভিশাপে রূপ নিতে নিতে আসমুদ্রহিমাচল প্রকম্পিত করতে থাকলে সেখানে কোন সমাজে টেকসই শান্তি আশা করা বৃথা।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.