শনিবার | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১

এই অবিরাম রক্তহোলির যবনিকাপাত কবে ?

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে চোখে পড়ার মতো। শহুরে মানুষের বহুতল ভবনের কাঁচের জানালা ভেদ করে রাতের রঙীন আলো দেখা যায় বহুদুর থেকে। বাসায়, মার্কেটে, সরকারী -বেসরকারী অফিসে-ভবনের নিচের পার্কিংয়ে দাঁড়ানো দামী গাড়িগুলোকে রাজকীয় গেইটের ফাঁক দিয়ে দেখে ভিখারীরা যখন ইশারায় ভিক্ষার জন্য দারোয়ানকে ডাকে তখন দারোয়ান তাদের অনেককে উচ্চস্বরে তাড়িয়ে দেয়। সেসব মানুষ অজপাড়াগাঁ থেকে নদীভাঙ্গন অথবা নানা ধরনের অভাবের তাড়নায় শহরে এসেছে বেঁচে থাকার আশায়। রিক্সা চালিয়ে অথবা দিনমজুরি করে যদি পেরে ভাত যোগাড় করে কোনরকমে জীবন বাঁচানো যায় সেই আশায়। কিন্তু শহরগুলোতে উঁচু উঁচু রাস্তা হয়েছে। সেগুলোতে রেল দৌড়ায়, পিচ্চি গাড়িগুলো সাৎ সাঃ করে চলে যায়। আজকাল শহরের মানুষগুলো তাদের রিক্সায় উঠে না। দীর্ঘসময় অবরোধ, সাট ডাউন হওয়ায় কাজের সন্ধানে রাস্তার মোড়ে রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ হয়ে পড়ে। কারণ, তাদের কাজ নেই। বাঁচার উপায় নেই। গ্রাম থেকে শহরে এসছিল যে আশাকে বুকে বেঁধে, সেটা এখন গুঁড়েবালির মতো মনে হচ্ছে।
অজপাড়াগাঁয় বিদ্দুৎ লাইন গেছে কিন্তু সেসব আসমানীদের সম্বল ছোট্ট ভিটার ভাঙ্গা ঘরে সংযোগ নেয়া যায়নি। পেটের ভাত যোগাড় করাই দায়, বিদ্দুৎ বিল দেবে কিভাবে? একটা বাল্বের মাধ্যমে পাশের বাড়ি থেকে সংযোগ নিলেও দুইশত টাকা দিতে হয়- সেটাই বা যোগাড় করবে কিভাবে? অনেক কাঁকুতি-মিনতি করেও তারা নদী পাড়ের সরকারী আশ্রায়ণে ঘর বরাদ্দ পায়নি। সেখানে তালিকায় নাম লিখেছিল। পরে চাহিদা মতো ঘুস দিতে পারেনি বলে নাম কেটে আরেকজনকে দিয়েছে। গ্রামে তাদের উপার্জন করার মতো কোন উপায় নেই। তাই শহরে গিয়ে ভালভাবে বাঁচতে ইচ্ছে হয়েছিল। পরিবার নিয়ে ভাসতে ভাসতে এখন অসুখে পড়ে হয়ে গেছে পথের ভিক্ষুক। রাস্তার মোড়ে বসে ভিক্ষা করতে হলে চাঁদা দিতে হয় সেখানকার মাস্তানকে। বাসাবাড়িতে গিয়ে ভিক্ষা করার উপায় দিনে দিনে হারিয়ে গেছে।
কিন্তু শহরের বড়লোকেরা ভীষণ কঞ্জুস! তারা সাহায্য অথবা দান করার জন্য দরজা খোলে না। শুক্রবারেও বাড়ির দরজা খুলতে চান না তারা। কেউ কেউ আমাদের চিল্লাচিল্লি শুনে পাঁচ দশটাকা ছুঁড়ে মারেন উপরের তলাগুলো থেকে। এসব ভিতরের কথা অনেকগুলো শহুরে ভাসমান মানুষের। যা আজকাল বিত্তশালীরা অনেকেই পাত্তা দিতে চান না। কিন্তু এটাই চরম বাস্তবতা।
তারাও শিক্ষার্থীদের ডাকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে শরীক হয়ে মাঠে নেমে গেছে। জুলাই তিন তারিখের বিকেলে রাজধানীর শহীদ মিনার চত্ত¡রে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জনসমাগম হয়েছে। হয়েছে অবিস্মরণীয় প্রতিবাদ সমাবেশ। যা হয়তো কেউ কখনোই দেখেননি। ছাত্রাবস্থায় একুশের রাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রোভার স্কাউটের দায়িত্ব পালন করেছি বহুবার। সেখানে মানুষ লাইন ধরে ফুল দিতে আসে। কিন্তু আজ যেন এই জনতার কি হয়েছে!
মানুষের সারি মিশতে মিশতে একাকার হয়ে জনসমুদ্র গেছে। শহীদ মিনারে আসার সব পথ মানুষের মাথায় গিজ গিজ করছে। ড্রোন দিয়ে ভিডিও করে টিভি-তে সরাসরি দেখানো হচ্ছে। শুধু মানুষ আর মানুষ। তাদের একটাই দাবী। সরকারের পদত্যাগ চাই। মানুষের মনের মধ্যে পুঞ্জীভূত সব ক্ষোভ, সব অভিমান, রাগ, উষ্মা, জমানো অভিযোগ একাকার হয়ে একটি মাত্র সংক্ষিপ্ত বাক্যে রূপ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। অবিলম্বে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ চাই।
দেশের শিক্ষার্থী, অবিভাবক, শ্রমিক, সাঁইত্রিশটি পেশাজীবি সংগঠন তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। রিক্সাওয়ালারা পশের পাশে রিক্সা থামিয়ে তার উপরে দাঁড়িয়ে কোরাস গাচ্ছে। গায়ক সমাজ নিজেদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দ্রোহের গান গাচ্ছে। সবার সাথে ভিখারিণীকেও শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় নাচতে দেখে মনে হচ্ছে নব্বই-এর গণ আন্দোলনের চেয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের তেজ বহু বহুগুণ বেশী জোড়ালো হয়ে জনগণের প্রাণের দাবীতে রূপ নিয়ে ফেলেছে।
সরকারী কর্তৃপক্ষ এতদিনে গণজাগরণের সম্বিত ফিরে পেয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের সাথে আলাচনার জন্য বসতে চেয়ে আহবান জানিয়েছেন। নব্বই-এর সামরিক সরকারের শেষ সময়ে একই ধরনের আর্জি বা আঁকুতি প্রচারিত হতে দেখা গিয়েছিল বিটিভি-তে। আজ ২০২৪ সালে এসে কিছু পোষা টিভিতে একই ধরনের আঁকুতি শোনা যাচ্ছে। নিজেদের বিবেক বন্দক রেখে গুটিকয়েক টিভি তথা গণমাধ্যম সরকারের অনেক অন্যায় কাজকে ভাল বলে প্রচার করছে। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনে জুলাইয়ে নিহতদের সঠিক সংখ্যা প্রচারে কপটতা প্রদর্শণ করায় তারা বিদেশী গণমাধ্যম ও দেশের জনগণের নিকট ধরা খেয়ে গেছে।
দেশের বর্তমান অচলাবস্থার জন্য সরকার বিচলিত হলেও এই ধরনের কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হীনতায় দেশের কর্ণধারকে অন্ধকারে রেখে প্রকৃত চিত্র আড়াল করার জন্য আজকের এই দুর্বিসহ অবস্থা তৈরী হয়েছে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করছেন।
কারণ, তারা অনেকে চোরের থাপইত কেউ কেউ চোরের সাগরেদ হিসেবে হিসেবে কাজ করেছেন। চোরের সাগরেদরা যতদিন মধু পেতে থাকে ততদিন থাপইতদের সাথে বিচরণ করে। অবস্থা বেগতিক দেখলেই সটকে পড়ে। চোরে থাপইত, সাগরেদ বাটপাদের রাজত্ব কায়েম হবার পলে দেশের সাধারণ মানুষ বৈষম্যের শিকার হয়। আমাদের দেশে কার্যত: সেটাই ঘটেছে।
যার ফলে বেনজির, মতিউর, শিকদার, হালদার ইত্যাদি মেগা-দুনীতিবাজ, মেগা-চোর ও ভয়ংকর ক্ষমতালোভী ডাকাতদের ব্যাপক উথ্থান হয়েছে। যাদের পদ ও দুর্নীতি এই দুয়ের সমন্বয়ে দ্বৈত ক্ষমতায়নের সুবাদে সাধারণ মানুষ কোন সেবা পায়নি। শুধু নির্যাতিত হয়েছে। তারা বড় বড় ব্যবসায়ীদের করের টাকা ফাঁকি দেয়ার সুযোগ করে দিয়ে ঘুসের বিনিময়ে নিজেদের সম্পদ বনিয়েছে। তারা মানুষের জমি, সম্পদ দখল করে পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, বিদেশে ৩০০ বড়ি, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করলে তাদের ভয়েও জনগণের কেউ টু-শব্দ করার উপায় খুঁজে পায়নি। তাদের দ্বৈত পেশাদারী দুর্নীতির ভূমিকা পালনে সহায়তা করেছে নমিনেশন কিনে ক্ষমতা বাগানো কিছু চরম অসৎ রাজনীতিক।
তাদের দাপটে, ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে নীতিবানরা কেউ টু-শব্দ না করলেও ছাগল কান্ডের মতো ন্যাচারাল টু-শব্দে গোমর ফাঁক হতে শুরু করলে সরকার সহ ওরা সবাই বিব্রত ও হতবাক হয়ে পড়ে। তারা এতদিন জনগণকে বঞ্চিত করলেও প্রকৃতি এবার তাদের বোকা বানিয়ে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’-এর আন্দোলনের প্রেক্ষিত তৈরী করে দিয়েছে বলে অনেক গুণীজন মনে করছেন। এটা আঁচ করতে পারলে দুর্নীবিাজরা পলায়ন করতে থাকে এবং থাপইতরা গা বাঁচানোর জন্য মিথ্যে প্রচারণা শুরু করে দেয়।
এসব চোরদের দুর্নীতিতন্ত্রের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আজকের আন্দোলন। যেটাকে সাধারণ মানুষ তাদের মনের কথা প্রকাশ করার মোক্ষম উপায় মনে করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলকে সমর্থন জানিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে। নির্যাতিত, নিপিড়ীত ও বঞ্চিত মানুষ একবার প্রতিবাদের সুযোগ পেলে তারা জীবনের মায়া ত্যাগ করে প্রতিবাদে শামিল হয়। সম্প্রতি শত শত কঁচি প্রাণের মৃত্যু এটাই প্রমাণ করে।
কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা তাদের বক্ত্যবে সাফ জানিয়ে দিয়েছে আর কোন আলোচনায় বসার পরিকল্পনা নেই তাদের। তাদের একটাই দাবী এখন। বর্তমান সরকারের পদত্যাগ চাই।
আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা বলছে, পদের লেবাসে চুরি করা, আইনের লেবাসে চুরি-ডাকাতি করতে সহায়তা করে বিপুল সম্পদ অর্জন ও আরো বড় পদ বাগানো একই সূত্রে গাঁথা। আইনের লেবাসে চুরি করে ফুলে ফেঁপে উঠায় পানি গড়িয়ে গোয়েন্দা ব্যর্থতা সব জায়গায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রাষ্ট্র হারিয়েছে রাজস্ব, দরিদ্র মানুষ হয়েছে আরো দরিদ্র। সর্বপোরি তাদের ব্যর্থতায় সামান্য কোটা সংস্কার আন্দোলনের গতিকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত হবার সুযোগ দিয়ে এতগুলো মূল্যবান প্রাণহানি হয়েছে। জুলাই ২০২৪ ম্যাসাকারে শত শত হত্যকান্ডের পর আগষ্টের চার তারিখে সন্ধ্যে নাগাদ একদিনেই ৭২ আন্দোলনকারী ও সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে ১৩ পুলিশ সদস্যও প্রাণ হারিয়েছে। এত রক্তপাতের শেষ কোথায় তা নিয়ে সবাই শঙ্কিত। এই অবিরাম রক্তহোলির শেষ কোথায়, কবে?
দেশের সম্পদ ধ্বংস হবার পাশাপাশি বিচক্ষণতাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের শোকে, দু:খে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে গোটা জাতি। কোন আশ্চর্য ওষুধে এই জনশোক প্রশমন করার উপায় নেই। আন্দোলনকারীরা কারফিউ প্রত্যাখ্যান করে রাস্তা দখল করে দাবী আদায়ে অনড় রয়েছে। এরপরও এত রক্তপাতের হোলিখেলায় যারা উন্মত্ত হয়ে পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন তাদের শেষ দৃশ্যটা দেখার জন্য দিনক্ষণ বেঁধে দেয়া নেই। সেই অপেক্ষার পালা দ্রুত শেষ হবে কি?

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.