মঙ্গলবার | ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ২ আশ্বিন, ১৪৩১

দ্বিতীয় স্বাধীনতার প্রয়োজন হলো কেন?

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
স্বাধীনতার আবার প্রকারভেদ কি? স্বাধীনতার সংস্করণ কি কাগজে ছাপিয়ে বের করতে হয়? কোন দেশ বা জনগোষ্ঠী কি বার বার শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রাণ বিসর্জন দেয়ার পর স্বাধীনতা লাভ করে? এমন উদাহরণ কি কোথাও রয়েছে? নাকি আমরাই দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথা বলে বিশ্ব রেকর্ড করতে যাচ্ছি? আমাদের প্রথম স্বাধীনতায় কি কোন ঘাটতি ছিল? কোটা আন্দোলনকারীরা প্রথম স্বাধীনতার বিরোধী নয়, সেসব ঘরের সন্তানও নয়। তাহলে স্বাধীনতার আঙ্কিক নম্বর বা দ্বিতীয় নামকরণ দিতে হলো কেন? এরকম নানা জটিল প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে জনমনে।
সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ৫ আগষ্ট ২০২৪ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পলায়ন করার পর মানুষের মনে যে স্বাধীতার আনন্দ সৃষ্টি হয়েছে সেটাকেই দ্বিতীয় স্বাধীনতা নামে অভিহিত করতে দেখা গেছে। ছাত্র নেতারা তো বটেই, বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন এটা আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা, স্বাধীনতা নম্বর- টু।
প্রবীণজনরা এটা শুনে মুচকি হাসছেন। তারা বলছেন, নতুন প্রজন্ম- তোমরা মাত্র দুটো স্বাধীনতার কথা বলছ। কেউ নিজের চোখে এর প্রথমটাও দেখনি। তখন তোমাদের অনেকের জন্মও হয়নি। আমরা কিন্তু চার-চারটি স্বাধীনতা দেখলাম। যাদের বয়স আশির উর্ধ্বে তারা আজ এমন কথা শোনাচ্ছেন।
তাঁরা ১৯৪৭ সালের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনকে ১নম্বর স্বাধীনতা লাভ বলছেন। এরপর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়ে মায়ের ভাষাকে আমাদের মুখের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রামকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলছেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজে বন্দুক হাতে গর্জে উঠে দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে তৃতীয় স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করছেন। যদিও সেটাই আমাদের বাংলাদেশ জন্মের প্রকৃত সাল।
আমরা নতুন প্রজন্ম ১৯৭১ সালকেই প্রথম স্বাধীনতা হিসেবে মনে করি। প্রথম স্বাধীনতা আমদেরকে একটি মানচিত্র দিয়েছে। পতাকা দিয়েছে লাল-সবুজ রঙের। একটি পাসপোর্ট দিয়েছে। বুক ফুলে চলার সাহস দিয়েছে। আরো অনেককিছু আমরা পেয়েছি। কিন্তু অনেক কিছু পেয়েও এমন কি জিনিষ পাইনি যার জন্য দ্বিতীয় স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রথম স্বাধীনতার ৫২ বছর পর নিজের স্বাধীন মাটিতে নিজের বাবা-ভাইদের গুলিতে আরেক বাবা-ভাইয়ের হাজরো সন্তানদেরকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হলো? স্বাধীনতার এমন সকরুণ ইতিহাস পৃথিবীর কোন দেশে কেউ কি কখনও দেখেছে? তা না দেখে থাকলে আমরা হয়তো এনিয়ে গিনেস বুকে রেকর্ড করে ফেলেছি।
তবে সম্প্রতি দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথা কেন এলো- তা শুধু রাজনৈতিক চিন্তায় না এনে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
প্রথম স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপন করতে পারেনি দেশের সকল মানুষ। তখন ঘরের ভেতর, মেসে, এয়ার বেজে, বাইরের রাস্তায় বিদেশী আর্মি ছিল। স্বাধীনতা ঘোষণার সময় ভারতীয় সেনারা আমাদের দেশের অভ্যন্তরে থাকায় স্বাধীন দেশ পেয়েও সাধারণ মানুষের সন্দেহ দূর হতে পারেনি। তখন প্রাণভরে উচ্ছাস প্রকাশ করতে পারেনি। তাই তখন স্বাধীনতার এত আনন্দ খুঁজে পায়নি।
দ্বিতীয়টি হলো- গত বায়ান্ন বছরেও প্রথম স্বাধীনতার ভিত ঠিকমতো গড়ে উঠেনি। নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কারণে আমাদের স্বাধীনতা বার বার আঘাত পেয়েছে, প্রতিবেশীদের অতিচালাকি ও কূটকৌশলের মারপ্যাচে আমাদের ন্যায্য অধিকারগুলো জোর ধাক্কা খেয়েছে। এখনও খাচ্ছে।
তৃতীয়ত: তোয়াজ-তোষণকারী ও পরনির্ভরশীল মানসিকতার ধ্বজাদারীদের জন্য আমাদের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি গড়ে উঠেনি! অধিকিন্তু পরনির্ভরশীল স্বাধীনতা বঞ্চিত সাধারণ মানুষকে প্রকৃত মুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের নবীনরা জাতীয়তার ভিত্তি বলতে বিভক্তি ও পরনির্ভরশীলতাকে ভাবতেই চায় না।
বহু বছর ধরে অধিকার, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতার হরণ নিয়ে অত্যাচারিতরা বার বার প্রতিবাদ করলেও সেগুলোকে গা করেনি ফ্যাসিস্ট চরিত্রের ক্ষমতালোভী শাসকরা। দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। শিক্ষিত বেকারদেরজন্য চাকুরীর প্রসার ঘটেনি বরং কোটা ব্যবস্থা দিয়ে সরকারী চাকুরীর প্রত্যাশা তাদের জন্য সংকুচিত করে তোলা হয়েছে।
চতুর্থত: গত কয়েক বছরে ঘরে ঘরে স্থান পেয়েছে টাকা ভর্তি সিন্দুক! জানুয়ারী ২৩, ২০২৪ তারিখে একটি ছাপানো বাংলা দৈনিক পত্রিকার বড় শিরোনাম হলো দেশে ‘সিন্দুকের বিক্রি বেড়েছে’। এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে টাকা-পয়সা, সোনা-হীরা-মুক্তা ইত্যাদি রাখার জন্য সিন্দুক কেনার ধুম পড়েছে দেশে। শুধু এনালগ বা লোহার তালা-চাবিমারা আদিকালের সিন্দুক নয়। তারা ডিজিটাল ও বায়োমেট্রিক নিরাপত্তাসংযুক্ত সিন্দুকও কিনছেন। আগষ্ট ১৭, ২০২৪ তারিখেও একজন সাবেক সচিবের ঘর থেকে নগদ তিনকোটি অবৈধ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে!
বাংলাদেশের উঠতি বিত্তশালীরা একদিকে টাকা-পয়সা ও সোনদানা রাখার জন্য ব্যাংকের উপর আস্থা রাখতে না পেরে নিজেরাই সিন্দুক কেনার ধুম তুলেছেন। অন্যদিকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থকে আইনের ভয়ে আড়াল করে রাখা। ঘুস, দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ায় একশ্রেণির মানুষ অতি দ্রুত বিত্তশালী হয়ে পড়ায় তাদের অঢেল অবৈধ অর্থকে লুকিয়ে রাখার জন্য সিন্দুক কিনে ভরে রেখে মধ্যযুগীয় কায়দায় নিজেদেরকে দুর্নীতি খেকে আড়াল করার অপকৌশল শুরু করেছেন।
বিশ্লেষকগণ বলছেন, দেশে নানা কারণে সিংহভাগ মানুষের আয় কমে গছে। পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যস্ফীতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য্যজনকভাবে গেল বছরগুলোতে কিছু মানুষের ব্যাপক আয় বেড়েছে। এটা আর্থ-সামজিক উন্নতির লক্ষণ ছিল না-বরং আর্থ-সামজিক ও পারিবেশিক ভাঙ্গন ধরার স্থানীয় ও বৈশ্বিক চোর চক্রান্তের ভয়াবহ সংমিশ্রণ বিকশিত হয়েছে। অধিকিন্তু নি¤œ আয়ের মানুষের কল্যাণে সরকারী উন্নয়ন কাজে লাগেনি।
পঞ্চমত: গুম, আয়নাঘরের নির্মমতার পরিণতির বিস্ফোরণ হয়েছে এই আন্দোলনের মাধ্যমে। বিডিআর হত্যা, হেফাজত হত্যা করে কোন বিচার হয়নি- বরং সাহস অর্জিত হয়েছে বহুগুণ। গুম, খুন হওয়া পরিবারের সদস্যরা শুধুই কেঁদেছে। বিচারহীনতার জন্য তারা সবাই খুব কষ্টে ছিল, এখনও আছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় কর্তৃপক্ষ উন্নসিকতার সুরে অহংকারে গড় গড় করে বলেছিল-আর ছাত্ররা কি করতে পারবে? এমনকি শিক্ষকদের পেনশন বিরোধী আন্দোলনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলা হয়েছিল- শিক্ষকরা আন্দোলন করে করে ক্লান্ত হলে অচিরেই ঘরে ফিরে যাবে-এমন অবহেলা ও অপমানজনক উক্তি। যা শিক্ষকদের সাথে গোটা জাতিও ভাল চোখে দেখেনি।
ষষ্ঠত: ‘বরেরও মাসি কনেরও পিসি’-দের দৌরাত্ম্য সৃষ্টি দ্বিতীয় স্বাধীনতাকে ডেকে এনেছে। এতদিন দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাসের কবলে পড়ে মানুষ হা-হুতাশ করলেও মুক্তি মেলেনি। ‘নিত্যপণ্যের বাজারে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে যাদের জিহŸা অতি লম্বা হয়ে গেছে তারা কোনদিন কোন শাস্তিকে ভয় করেনা। ইহকালেরও না হয়তো পরকালের শাস্তিটাকেও না। পরকালেরটা না হয় অদেখা ও অতিদূরের তাই এখন উপলব্ধিতে আসে না। কিন্তু ইহকালের শাস্তি তাদেরকে দেবার কেউ ছিলনা। তারা জরিমানাকে তারা ভয় করে না। জেল খাটারও ভয়-ডর তাদের মনে জাগে না।’কারণ, চোরে চোরে মাসতুতো ভাই কায়েম হবার ফলে তারা হয়েছে চরম বেপরোয়া!
এজন্য এরা দুর্নীতির গতিতে স্মার্ট নাগরিক হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরুপ- বেনজীর, মতিউর, তাকসিম, শিকদার, হালদার ইত্যাদি মেগা-ঘুসখোররা দেশ থেকে স্মার্টনেস দেখিয়ে পলায়ন করেছেন। এছাড়া গেল বছরগুলোতে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মি: কমিশন খেতাবপ্রাপ্তরা সমাজে ভয়ংকর গোছের মামদোভূত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
এসব বিষয় মুখ বুঁজে সমর্থন করেও ফায়দা হয়নি মানুষের। নিচে আগুন জ্বলতে থাকলে উপরে টগবগ করতে করতে বিস্ফোরিত হয় ! তার সর্বশেষ বিস্ফোরণ ঘটেছে ৫ আগষ্ট রাস্তায় সকল শ্রেণির জনতার ঢাকামুখী ঢল নেমে।
সপ্তমত: ভালকে ভাল বলতে ভুেল যাওয়া- ইর্ষার রাজনীতি ভাল কাজ ছিল না। যেমন, সরকার সবসময় বলতো ইউনূস মন্দলোক। দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে সেটা সংগে সংগে প্রচারিত হতো। পদ্মাসেতু দেখতে গেলে ড. ইউনূসকে টুপ করে দু’বার চুবাতে বলাটা দেশের মানুষ মেনে নেয়নি। দেশের কর্ণধারের এমন উক্তি শোনার পর দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ীকে হেয় করতে ছাড়েনি অনেক জ্ঞানপাপীও। তাই বাঘা প্রফেসর, তোষণকারী সাংবাদিক, মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরাও ইউনূসকে মন্দ বলা শুরু করে। অথচ বিশ্বের ১০৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মুহাম্মদ ইউনূস সেন্টার’ আছে। বহু দেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উন্নয়ন দর্শন অনুযায়ী ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি চালানো হয় ও জাপানসহ কয়েকটি উন্নত দেশে স্কুলের পাঠ্যসূচিতে পড়ানো হয়।
দেশটা ছোট-বড়, উচু-নিচু সব মানুষের। প্রথম স্বাধীনতার মাধ্যমে যেটা অর্জিত হয়েছিল। কারণ, স্বাধীনতার স্বাদ অর্জন করা এদেশের সবার জন্মগত অধিকার। দ্বিতীয় স্বাধীনতা কথা উঠেছে, কারণ মানুষের অধিকার, বাকস্বাধীনতা, বেঁচে থাকার স্বাধীনতা, বিচার পাবার স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে ভয়ংকরভাবে। ঘুস, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারীতা, মুদ্রাপাচার, সীমান্ত হত্যা, মাদক ও সন্ত্রাস শব্দগুলোর প্রতি মানুষের যারপরনাই ঘৃণা জেগে উঠেছে । শিক্ষিত বেকারত্ব, ভিক্ষাবৃত্তি, সামাজিক বৈষম্য, দ্রব্যমূল্যসন্ত্রাস ইত্যাতি বাড়িয়ে তুলেছে সীমিত আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস। এগুলো নির্মূল করে গণদারিদ্রকে চিরতরে জাদুঘরে পাঠানোর কাজটি সম্পন্ন করা করার সুযোগ সৃষ্টিকে বলা হচ্ছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা !
আমাদের দেশ প্রতিটি নাগরিকের। এই প্রতিষ্ঠান সবার জন্য শান্তির প্রতীক হোক। এজন্য একটি টেকসই সমাজ তৈরীর জন্য মানবদরদী, নির্লোভ মানুষগুলোকে সম্পৃক্ত করে উন্নয়নের প্রতিটি ধাপে ফলোআপ জোরদার করে অগ্রসর হতে হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে অর্জিত নম্বরধারী স্বাধীনতাকে কোন রাজনৈতিক রং না লাগিয়ে সেটা কেন প্রয়োজন হলো তা মনে রাখা দরকার। সবাই মিলে মিশে পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেশের কল্যাণে নতুন উদ্যমে আবারো কাজ শুরু করি- এটাই হোক সবার লক্ষ্য।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.