বৃহস্পতিবার | ২১ নভেম্বর, ২০২৪ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১

অবৈধ উপরি কামাই উপভোগ ও টেকসই সংস্কার

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের আয়োজন চলছে। এজন্য সরকারীভাবে নীতি প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। কোনটা আগে কোনটা পরে সংস্কারের আওতায় আসবে তা নিয়ে নানা মতামত ও পরামর্শ শোনা যাচ্ছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের জন্য সবার আগে দাবী রাখে কোন ক্ষেত্রগুলো তা নিয়ে অনেকটা হিমশিম খাবার মতো অবস্থা তৈরী হয়েছে। সংস্কারের আগেই বিভিন্ন দাবী পূরণের জন্য দল বেঁধে মাঠে নেমে যাচ্ছে বঞ্চিত মানুষ। ফলে প্রতিদিন সূর্যের আলো ফোটার আগেই নানা সেক্টরে নতুন করে সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে। যেন সবার ভেতরে এত বছর ধরে শুধু সমস্যার পাহাড় জমা হয়েই ছিল। কেউ এতদিন তাদের সমস্যাগুলো মুখফুটে কারো কাছে প্রকাশ করার সুযোগ পায়নি বলে মনে হচ্ছে।
তার মূল কারণ সব সেক্টরে বিভেদের দৌরাত্ম্য এতটাই ফাঁরাক তৈরী করেছিল যে, একটি বঞ্চিত শ্রেণি চরম হতাশ হয়েও তাদের কষ্টের কথা সাহস করে বলতে পারেনি। একটি ইতিবাচক পরিবেশের অভাব ও অজানা ভয় তাদেরকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
মোটাদাগে, সেই বিভাজনটা চরম আয় বৈষম্যের। কোন কাজকর্ম না করে শুধু তোষণ-তোয়াজের মাধ্যমে কেউ টাকার পাহাড় গড়েছেন। কেউবা দলীয় লেজুড়বৃত্তি করে নিজের দুর্নীতি, জালিয়াতি ইত্যাদিকে আড়াল করে বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন। অপরদিকে অবৈধ মজুতদারী, কালোবাজারী, দ্রব্যমূল্যস্ফীতি ঘটিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা হাতিয়ে নিয়ে নিম্নশ্রেণির মানুষকে শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষণ করেছেন। যার প্রভাব সমাজে এখনও বিদ্যমান রয়েছে।
এর সাথে তাল মিলিয়ে বেড়ে গেছে অবৈধ ‘উপরি কামাই’করার প্রবণতা। বিশেষ করে সরকারী চাকুরীজীবিদের অনেকের মধ্যে অবৈধ উপরি কামাই লিপ্সা এতটাই বেড়ে গেছে যে, তারা নিজেদের দায়িত্ব ভুলে গিয়ে বৈধ বেতনের পাশাপাশি আরো কতিপয় অবৈধ আয়ের পথ সৃষ্টি করে মানুষকে হেনস্থা শুরু করে দিয়েছিল। নিয়োগ, বদলী, প্রমোশন ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা আয়ের গোপন সুড়ঙ্গ তৈরীর কথা নতুন করে লিখে বলার অবকাশ নেই।
বিভিন্ন নির্মাণ কাজে কমিশনের নামে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের পরিমাণ অধুনা জাতিকে হতবাক করে তুলেছে। এর পাশাপাশি প্রতিটি সেবা ক্ষেত্রে কর্মচারীদেরকে খুশি করার নামে ঘুস তথা অবৈধ আয়ের আঞ্জাম করে না দিলে কাজ সম্পন্ন করা দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। এগুলোই ঘুস-দুর্নীতি বা উপরি আয়ের রুট হিসেবে বিবেচিত।
এর বৃহত্তর রুপের আবির্ভাব হয়েছিল জরুরী সরকারী ক্ষেত্রগুলোতে অসংখ্য ‘হোয়াইট কলার ক্রাইম’নামে। যেটা আমাদের দেশে মেগাদুর্নীতিবাজ খেতাবে পরিগণিত হয়ে মানুষে-মানুষে আয়বৈষম্যকে পরিহাস করতে শুরু করেছে। যার প্রভাবে সামাজিক বৈষম্য চরমে উঠে গিয়ে একটি সুসংগঠিত সামাজিক আন্দোলন সূচিত হয়েছিল। কিছুদিন আগে সেসকল বৈষম্য ঠেকাতে সাধারণ মানুষ সামাজিক ‘ফায়ারওয়াল’বা অগ্নিদেয়াল তৈরী করে বিদ্রোহী হয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছিল।
এর একমাস না পেরুতেই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনসৃষ্ট সংস্কারকগণ মাঠে নামার সুযোগ পেয়ে গেছেন। যারা সংকল্পবদ্ধ হয়েছেন বিভিন্ন জরাজীর্ণতাকে মেরামত করে নির্দিষ্ সময়ের মধ্যে একটি গতিশীল সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উপহার দেবার। কিন্তু অতিদ্রুত কীভাবে সেটা সম্ভব?
সেজন্য বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়ে গেছে। এর পক্ষ-বিপক্ষ যাচাই-বাছাই করে বক্তব্যও শোনা যাচ্ছে। দেশের সংসদীয় নীতি নির্ধারকগণ ৫ আগষ্টের পর পদ হারিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। তবে দেশের বিজ্ঞ গবেষক ও অভিজ্ঞ পরামর্শকগণ মন খুলে কথা বলা, মতামত ও পরামর্শ দেবার সুযোগ পাবার সুবাদে সেমিনার সিম্পোজিয়াম সোচ্চার হয়ে উঠছেন। এটাই মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা লাভের দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। এরসাথে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কোনঠাসা গুণী ব্যাক্তিগণ হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন বলে মনে হচ্ছে।
মাত্র একমাস পূর্বে একদল গুণী সাংবাদিক পলাতক প্রধানমন্ত্রীকে নানা পরামর্শ দিতে গিয়েছিলেন। সেসব কথা এখানে আর নতুন করে বলার অপেক্ষা নেই। সম্প্রতি নতুন অন্তবর্তী সরকারের সাথে আরেকদল গুণী সাংবাদিক তাদের মনের কথা প্রকাশ করতে পেরেছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন-সেই ত্রিশজন কে ছিল আর এই ত্রিশজন কারা? এখন ‘সেই’আর ‘এই’ নিয়ে বিতর্ক করার সময় নয়। তবে পরের দৃশ্যটি জাতিকে নতুন করে আশার আলো জাগাতে যাচ্ছে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করছেন। পরবর্তী ত্রিশজনের কথা কিছুটা হলে এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা যাক।
অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক সভায়, ‘গণমাধ্যমকে সরকারের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবার আহবান করেছেন।’ তিনি ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ার পাশাপাশি সেগুলো শুধরানোর জন্য উপায় বাতলে দেয়ার পরামর্শ চেয়েছেন। কারণ, আমরা জানি কোন কিছুর ভুল ধরা না হলে সেটা শুধরানোর প্রশ্নই আসে না। ভুল চিহ্নিত করাটাই হলো সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ।
এতদিন ভুল যাতে কেউ না ধরে সেজন্য কঠিন পর্যবেক্ষণ চলতো। ভুল চোখে পড়তে পারে এমন ঘটনা বা অবস্থার প্রচারণা যাতে না হতে পারে সেজন্য গণমাধ্যমের উপর নজরদারি করা হতো। এমনকি সব ধরনের বড় সমস্যা থেকে রাষ্ট্রের কর্ণধারকে গোপনে-আড়ালে রাখার ব্যবস্থা হতো। এজন্য বহু অভিজ্ঞ সম্পাদক, গণমাধ্যমকর্মী সদা ভয়ে ভয়ে কাজ করতেন বলে জানা যেত। সবচেয়ে দুর্দিন গেছে মাঠ ও চারণ সাংবাদিকগণের ক্ষেত্রে। কেউ একটু বেশী নড়চড় করলে তার উপর নেমে আসতো ভয়ংকর রকমের চাপ, নির্যাতন আর হতাশা।
সেই চাপ ও কঠিন অবস্থা আর ফিরে চান না কোন মুক্তমনের গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ত¡গণ। সেসব নীতির দ্রুত অবলোপন চান তারা। অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা গণমাধ্যমের উপর যে উদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন তা একটি সত্যিকারের মুক্ত, গতিশীল, সক্রিয় বা ‘ভাইব্রান্ট’গণমাধ্যম কাঠামো তৈরীতে সহায়ক হতে পারে। যেটা দেশের প্রশাসনিক সংস্কার ও নানা ক্ষেত্রে চলমান বৈষম্য নিরসনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো এই মূহুর্তে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কোনগুলো? কোন কোন সংস্কার দেশকে দুর্নীতির রাহু থেকে মুক্তি দিয়ে আর্থ-সামজিক বৈষম্য নিরসনে দ্রæত সাহায্য করতে পারে? অবশ্যই সংস্কার হতে হবে টেকসই ধরণের। এর জন্য নানা কমিশন গঠনের পদক্ষেপ চলছে। একজন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বলেছেন, সবার আগে প্রয়োজন সংবিধান সংস্কার। একটি সুঠাম আইন ও সাংবিধানিক কাঠামোর উপস্থিতি ব্যতিরেকে রাষ্ট্রীয় সংস্কার কাজে হাত দেয়া মুষ্কিল। অতীতের সকল কালাকানুন বিলোপ ছাড়া নতুন পরিবর্তন চাওয়া অবান্তর।
এর পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, পরিবেশ সুরক্ষা কমিশন, অর্থ ও সামাজিক নিরাপত্তা কমিশন পুনর্গঠণ করা প্রয়োজন। সামাজিক নিরাপত্তা কমিশনের আওতায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্যসুরক্ষা, চাকুরী, যুব-নারী-শিশু উন্নয়ন, সামাজিক অপরাধ, পরিবহন, স্থির দ্রব্যমূল্য, বয়স্ক কল্যাণ, বীমা, পেনশন ইত্যাদি সবকিছু অর্ন্তভূক্ত করা যেতে পারে। উন্নত বিশ্বে এসবকিছুই মানুষের কল্যাণে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আওতায় বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
উল্লিখিত সবকিছুর মধ্যে জনগণকে নিজ নিজ কর্মঘন্টা নষ্ট না করার জন্য সজাগ ভূমিকা পালন করতে হবে। নিজ কাজের জবাবদিহিতা নিজেকেই নিশ্চিত করে অপরের ‘হক’বা অধিকার ক্ষুন্ন না করার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। সকল প্রকার অবৈধ লোভ-লালসাকে জলাঞ্জলি দেবার মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে ‘উপরি কামাই’গ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্য প্রতিজ্ঞা করতে হবে।
অবৈধ ‘উপরি কামাই’গ্রহণ থেকে সমাজে আয়বৈষম্য সৃষ্টি হয়, দ্রব্যমূল্যস্ফীত হয় এবং ভোগবৈষম্য ঘটে। কারণ সৎমানুষ উপরি কামইকে ঘৃণা করে। অসৎদের সাথে তুলনায় সৎ ব্যক্তির আয় কমে যাবার ফলে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সঞ্চয়, নিরাপত্তা ইত্যাদি সবকিছুতে হযবরল তৈরী হয়। উপরি কামই উপভোগকারীদের বিপরীতে চরম বৈষম্যের ঘেরাটোপে সৎ, দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ দীর্ঘদিন যাবত ভূগছেন। তাই একটি টেকসই সংস্কার সূচিত হোক সকল শ্রেণির মানুষের কল্যাণে।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.