বৃহস্পতিবার | ২১ নভেম্বর, ২০২৪ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১

তদ্বির: কল্যাণরাষ্ট্রের ভয়ংকর অসুখ

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
অন্তর্বর্তী সরকারের একজন তরুণ উপদেষ্টা সেদিন দ্বিতীয়বারের মতো বললেন, ‘পঞ্চাশজনের মধ্যে আটচল্লিশ জনই তদ্বির নিয়ে আসেন’(ইত্তেফাক ১৬.০৯.২০২৪)। অর্থাৎ, তার কাছে বা দপ্তরে যারা দেখা করতে আসেন তাদের ছিয়ানব্বইভাগই আসেন কোন না কোন কাজ উদ্ধারে অবৈধ ‘তদ্বির’নিয়ে। এটা সামাজিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থি এবং কল্যাণরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটা ভয়ংকর অসুখ।
কথা হলো তদ্বিরকারীরা আগের মতো সচল হয়ে উঠলে বৈষম্য দূর হবে কীভাবে? তোয়াজ-তোষণ তদ্বিরের দ্বারা অপরের ‘হক’কেড়ে নেয়া হয়। তদ্বিরের মাধ্যমে ঘুস, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, জালিয়াতিকে প্রশ্রয় দেয়ার সুযোগ তৈরী করে দেয়া হয়। এতে প্রকৃত মেধাকে চরম অবমূল্যায়ণ ও অপমান করা হয়। এর ফলে অফিস-আদালত, সমাজ, রাষ্ট্রের প্রতিটি কর্ণারে বৈষম্য মাধা চাড়া দিয়ে উঠে। এর ফলে অরাজকতা তৈরী হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে ভাঙ্গন ধরে। যেটা কিছুদিন আগে আমাদের দেশে প্রকট নামাজিক অরাজকতা সৃষ্টি করে সামাজিক বিপ্লব সূচিত করেছিল।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নায়কদের কাছে যদি শতকরা ছিয়ানব্বইভাগ মানুষ তদ্বির নাম ভয়ংকর অসুখের বার্তা নিয়ে হাজির হবার সাহস পায় তাহলে দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রে কি অরাজকতা চলছে তা নতুন করে বলার অপেক্ষায় নেই। তা হলে পরিবর্তন হলো কোথায়?
পদোন্নতি নিয়ে সচিবালয়ে আমলাদের মধ্যে মারামারি করার চিত্র মাত্র কয়েকদিন আগের। আগে যারা তোয়াজ-তোষণ তদ্বিরের দ্বারা লাইম লাইটে থাকতো তারা এখন অবস্থা বেগতিক আঁচ করতে পেরে বঞ্চিত, নিরীহ সহকর্মীদের গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করছেন না। আগে সরবে, গোপনে ঘুস, পুকুরের ইলিশ, ভেটকি, খামারের খাসি-গরু উপহার দিয়ে তদ্বির করে কাজ উদ্ধারে তৎপর ছিলেন তারা এখন সরাসরি মারামারি করতে দ্বিধা করছেন না। জাতি এখন এএসব দৃশ্য আর দেখতে চায় না।
তাই পুরনো সব নিয়মকানুন, অন্যায়ের তালিকা ঝেড়ে- মুছে পরিস্কার করে নতুনভাবে সবকিছু ঢেলে সাজাবার সময় এসেছে। একটি ন্যায়ানূগ নীতিমালা অনুসরণ করতে অপারগ হলে জাতি আবার আপনাদেরকে ধিক্কার দেবে অথবা ধাক্কা দিতেও দ্বিধা করবে না!
বছর খানেক পূর্বে একটি এক্সট্রা-একাডেমিক সভায় উপস্থিত ছিলাম। সেটি একটি নামকরা সভাঘরে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। অতিথিতে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল সভাঘরটি। তবে বক্তার সংখ্যাও ছিল অনেক। মঞ্চের সীমিত আসনে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় আরো কিছু নতুন আসন পেতে বক্তাদের বসার জায়গা করে দেয়া হয়েছিল। বক্তাদের ভীড়ে উপস্থাপকের ডেস্ক পর্দার আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছিল। উপস্থাপকের হাতে থাকা পূর্বনির্ধারিত বক্তাদের চেয়ে আরো অনেক নতুন বক্তা আসায় তিনি বার বার নাম ভুল করে উপস্থাপন করছিলেন এবং নেতাদের ধমক খাচ্ছিলেন।
আমিও সেখানে একজন বক্তা ছিলাম। আমার সেখানে মাত্র একঘন্টা থাকার কথা ছিল। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ আসনে বসে অপেক্ষা করার পর মূল অনুষ্ঠান শুরু হলো। সময় পেরিয়ে যাবার পর একেকজন রাজনৈতিক নেতা গোছের কেউ এলে তাকে তোয়াজ করে উচ্চস্বরে শ্লোগান দিয়ে মঞ্চে তুলে নতুন চেয়ার পেতে ঠেলেঠুলে বসিয়ে দেয়া হচ্ছিল। একজনের ফুলের তোড়া ছিনিয়ে নিয়ে অনির্ধারিত আরেকজনকে প্রদান, একজনের গলার উত্তরীয় টেনে খুলে নিয়ে আরেকজনকে দেয়া- ইত্যাদি করে সে এক বিশ্রি পরিবেশ ও বিরক্তিকর অবস্থা দেখার অভিজ্ঞতা সেদিন হয়েছিল।
এরপর যা ঘটতে থাকলো তা হলো- অনাহুত বক্তাদের হাতে সময় নেই। তাদেরকে আগে বক্তব্য দিতে সময় দিতে হবে! সেটাই করতে হলো।
কিন্তু তারা বক্তব্য শুরু করার পর আর থামার নাম-গন্ধ নেই। একাডেমিক বিষয়ের বক্তব্য না দিয়ে তারা রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে সময় ক্ষেপণ করে ফেললেন। তাদের কথা শেষ করেই একে একে সভাস্থল ত্যাগ করে চলে যেতে থাকলেন। ইতোমধ্যে বিরক্ত হয়ে দর্শক-শ্রোতাদের অনেকেই সভাস্থল ত্যাগ করে চলে গেছেন। ফলে সভার মূল বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত সেদিন তাদের কানে পৌঁছানোর সুযোগ হয়নি।
আরেকদিনের ঘটনা কিছুটা শেয়ার করি। সেখানে বক্তারা মঞ্চের প্রধান অতিথি ও অন্যান্য অতিথিদেরকে বার বার একই সুরে এত বেশী সম্বোধন করে বক্তব্য শুরু করেছিলেন যে, বরাদ্দকৃত সময়ের উপর তাদের কারো কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। প্রায় সব বক্তা বার বার একই বিশেষণ ব্যবহার করে শুরুট অতি লম্বা করে ফেলায় এক চরম বিরক্তির অধ্যায় সূচিত হয়েছিল সেদিন। শ্রুতিকটু, দৃষ্টিকটু, অসহ্যকর বিষয় ছাড়াও তোয়াজ-তোষণের মাত্রা এত বেশী সীমা ছাড়িয়ে গেছে যে অনেক অতিথি তাদের জবাবে সেটাকে ‘অতিভক্তি চোরের লক্ষণ’বলতে দ্বিধা করেননি।
কথা হলো, কোন সভায় বার বার কাউকে এই ভাষায় সম্বোধন করে বিরক্তি সৃষ্টির কালচার কেন? জাতি হিসেবে আমরা তোয়াজ-তোষণকে পছন্দ করি বলে কি এই বদভ্যাস চালু রাখতে হবে?
এর মূল কারণ অন্য জায়গায়। আমরা এমন কিছু বদঅভ্যাসকে আত্মস্ত করে ফেলেছি যেগুলো নিয়ে সমাজে অনেক ঘৃণিত প্রবাদ প্রবচন চালু রয়েছে।
যেমন বাঙ্গালীর সময়জ্ঞান নিয়ে উষ্মা ও তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা আমাদের মজ্জাগত। ‘ন’টার ট্রেন ক’টায় ছাড়ে’ প্রবাদটি অতি আধুনিক যুগেও আমাদেরকে তাচ্ছিল্য করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে এই অপবাদ বিদূরিত করার উপায়ও আমাদের নেই। কারণ এখনও আমাদের দেশের সচল নার্ভাস সিস্টেম বা অবিচ্ছন্ন বিদ্দুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য সময়জ্ঞান ট্রাফিককে খেয়ে ফেলেছে।
সময়ের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শুরু করতেই হিমশিম খাচ্ছি। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারাটা এখনও আমাদের মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে রয়েই গেছে!
তোয়াজ-তোষণের মাত্রা প্রতিটি সেক্টরে দুর্গন্ধ ছড়ায় আর সময়জ্ঞানের উদাসীনতা সেই দুর্গন্ধকে আরো ঘণীভূত করে তোলে। তাই এই বিষয়টি আজকাল অতি গুরুত্বের সাথে আমলে নিতে হবে।
এই অতিথিকে বার বার তোষণের মাধ্যমে অযথা সময় ক্ষেপণ করা পরিহার করার সময় এসেছে। এআই যুগে কেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা যাবে না?
কোন কিছুতে তোয়াজ-তোষণের মাত্রা বেশী হলে সময়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটে। তবে এআই যুগ এসও অনেকের কাছে তোয়াজ-তোষণ করাটা ভাল লাগে। তাই অপরের কাজের ক্ষতি করে তাদের জন্য সময় বাড়ানো হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় চারদিকে ক্ষতির মাত্রা বেড়ে গিয়ে মূল লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতার চিত্র ফুটে উঠে।
আরো একটি অনাচার আমাদের মজ্জাগত হয়ে উঠেছে। অনেক বিচিত্রানুষ্ঠান, নাটক, সিনেমা, কনসার্ট, ইত্যাদি কোরআন তেলাওয়াত ও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম’বলে শুরু করা হয়। এরপর ভেতরে শুরু হয়ে যায় গান-বাজনা, অশ্লীল উদ্দাম নৃত্য। এই বৈপরীত্য কি কোন অনুষ্ঠানে বরকত নিয়ে আসে? তা আমার বোধগম্য নয়। যেটা যে চরিত্রের অনুষ্ঠান, সেটা সেই বৈশিষ্ট্য দিয়ে শুরু ও শেষ করা উচিত। যে কোন জায়গায় মুসলিমদের কাজে কর্মে মনগড়া চিন্তার বাস্তবায়ন ও মোনাফেকী প্রদর্শণ করা অনুচিত।
মূল কথা হলো- যে কোন সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কনফারেন্সে একই ব্যক্তিকে সব বক্তা বার বার একই কায়দায় সমম্বোধন ও তোষণ না করে বরং সময়ের অপচয় রোধ করা উচিত।
সময়মতো অনুষ্ঠান শেষ হওয়া উচিত। অনুষ্ঠানের আউটপুট নিয়ে জবাবদিহিতা থাকা উচিত। যথার্থ আউটপুট ছাড়া সভা অনুষ্ঠানের দরকার কি তা স্পষ্ট হওয়া উচিত। কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে, সাজ সজ্জা করে বাহারি শ্লোগান দিয়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার দিনকে বিদায় জানানো উচিত।
কোটি কোটি টাকার অপচয় করে কনভোকেশন করার দিন শেষ ঘোষণা করা উচিত। এখনো অক্সফোর্ডের বারান্দায় টেবিল সাজিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের কনভোকেশনের সার্টিফিকেট বিতরণ করা হয়। আমাদের দেশে ৫-৬ কোটি টাকা ছাড়া কনভোকেশনের মঞ্চ তৈরী ও ডামাডোল শেষ করা যায় না। অথচ, শিক্ষার্থীদের ক্লাশরুম নেই, বই নেই, পড়ার টেবিল নেই, কম্পিউটার নেই, শোবার ঘর নেই, ডাইনিংয়ে মানসম্মত খাবারে ব্যবস্থা নেই, মেডিক্যাল সেন্টারে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই। প্রতিবছর কনভোকেশনের এই পরিমাণ টাকা দিয়ে একেকটি নতুন আবাসিক হল নির্মাণ বা পরিবহণের জন্য নতুন এসি যানবাহন কেনা সম্ভব। মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা এবং গবেষণার কাজে সেই অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে।
শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-ই নয় দেশের সকল পেশাদারী, সেবাদারী প্রতিষ্ঠান থেকে সময় অপচয়ের কৃষ্টি অচিরেই নি:শেষ করার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবী রাখে।
তাই একজনকে অতি সম্বোধন-তোষণ কৃষ্টি আর নয়। বার বার অতি সম্বোধন করে বিরক্তি সৃষ্টি নয়, সময় ক্ষেপণ করে অপচয়ের কালচার জিইয়ে রাখা আর নয়। মূল কাজে দ্রুতগতি ফেরানোর সময় এখন। দেশ গড়ার সময় এখন এআই-এর তালে সামঞ্জস্য রেখে। তা-না হলে আমরা বার বার হোঁচট খেতেই থাকবো।
সবাই মাত্র একদিনের জন্য বা নিদেনপক্ষে একবারের জন্য হলেও অতি সম্বোধন- তোয়াজ-তোষণ, তদ্বির কৃষ্টির বিরুদ্ধে কথা বলি, অপরের ন্যায্য ‘হক’ নষ্ট করে স্বার্থপর না হই। এছাড়া যে কোন একাডেমিক প্রোগ্রামে, সেমিনারে, সভায়, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অর্থের অপচয় রোধ ও কাজের সময় বাঁচানোর জন্য এটা হতে পারে একটি যুগান্তকারী উদাহরণ।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.