শনিবার | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১

ফিলিস্তিন নিরাপদ না হলে ইসরাইলও অনিরাপদ থাকবে

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
এখনকার যুগে যুদ্ধের কৌশল ও গতি-প্রকৃতি বদলে গেছে। যোদ্ধা ও যুদ্ধাস্ত্র বিষয়টিও সম্পর্কেও নবতর ধারণার সংযোজন ঘটেছে। রক্তমাংসের যোদ্ধা বা সৈনিকের পরিবর্তে রোবট চালিত স্বয়ংক্রিয় যোদ্ধার প্রচলণ অনেক আগেই শুরু হয়েছে। সফট্ওয়্যার নিয়ন্ত্রিত আধুনিক যন্ত্রসৈনিক মোতায়েন করে অনেকে স্বস্থির নিশ্বাস ছেড়ে অহমিকা নিয়ে দিন ক্ষেপণ করে চলেছেন। তবে এসবকিছুতে নিরাপত্তা ও শান্তি মনে করে ক্ষান্ত দিয়ে অবকাশ দেবার ফুরসৎ কোথাও নেই। কারণ প্রযুক্তি নিয়ত পরিবর্তনশীল। প্রযুক্তির পরিবর্তনের এই প্রবণতা এত বেশী দ্রæততার সাথে সংঘটিত হচ্ছে তা অনেক আধুনিক যুদ্ধবেত্তাদের নিকটও বোধগম্য নয়। তার প্রমাণ দেখা গেছে ইসরাইলের আয়রন ডোমের অসাড়তার বেলায়।
হামাসের স্বল্পপাল্লার রকেটে প্রতি সেকেন্ডে ক্ষেপণগতি ও ক্ষেপণসংখ্যা কিছুটা বাড়ানোর ফলেই কুপোকাত হয়ে গেছে আয়রণ ডোম। এতদিনের নির্ভরশীল মনে করা আয়রন ডোম চতুর্মুখী রকেট আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে বাঁক ঘুরতে না ঘুরতেই সেই ফাঁকে শত শত রকেট সামনে এগিয়ে গেছে। সজোরে আঘাত হেনেছে লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে। ইরাক যুদ্ধের সময় আমেরিকার অ্যাপাচি হেলিকপ্টার ও স্কাড খুব ভয়ংকর অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। কারণ সেটা প্রতিহত করার মতো ইরাকের কোন নিরাপত্তা বলয় ছিলনা। এখন ঘাড়ের মধ্যে বহনযোগ্য রকেট ছুঁড়েই অ্যাপাচি হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমানকে ঘায়েল করা হচ্ছে। এসব অস্ত্র পুরনো বিবেচনা করে পশ্চিমা যুদ্ধবাজ দেশগুলো সেগুলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বিনামূল্যে সরবরাহ করে যাচ্ছেন। বলা হচ্ছে, সেগুলোর কিছু অংশ হামাস ও হিজবুল্লাহর হস্তগত হয়ে সম্প্রতি ইসরাইলের উপর আক্রমণ করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো দিয়ে শত্রæপক্ষ ছাড়া হামলাকারীরাও হতাহত হয়ে থাকেন। তাই এসব এখন সেঁকেলে অস্ত্র। মানুষ এখন বিলাসী হয়েছে। বিশেষ করে সৈনিকদের আয়াসী জীবন-যাপন করার ব্যবস্থা প্রতিটি দেশেই স্বীকৃত। তারা একটু র‌্যাংক পেলেই শুধু অধ:স্তনদের নির্দেশ দিয়ে যুদ্ধ করতে পছন্দ করেন।
এছাড়া নিজেরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে নিজেরা বেঁচে থেকে যুদ্ধে জয়লাভ করে আরো বেশীদিন পৃথিবীকে উপভোগ করতে চান। এজন্য আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত মারণাস্ত্র তৈরীর বাজেট বাড়ানো হয়েছে। তাই দেশে দেশে কৃত্রিম বুদ্ধিনির্ভর আরো অত্যাধুনিক অস্ত্র বানানোর জোর প্রচেষ্টা চলছে। অনেক বৃহৎ শক্তিধর দেশ এ ব্যাপারে সফলতার দাবী করে চলেছে। তাহলে আজ থেকে ৪০-৫০ বছর পূর্বে যেসব পারমাণবিক ওয়্যারহেড তৈরী করে নিজেকে মহাশক্তিধর হিসেবে জাহির করে আস্ফালণ চলছে সেগুলো কি গতির নিকট দুর্বল হয়ে ঘুমিয়ে আছে? নাকি হামাসের হাতে নিক্ষেপ করা রকেটের গতির নিকট পরাজিত হয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার পূর্বে আকাশেই গুঁড়িয়ে দেয়া সহজ? কারণ তৈরীকৃত সেসব পারমানবিক অস্ত্র কেউ ব্যবহার অথবা ধ্বংস করেছেন বলে শোনা যায়নি। বিপজ্জনক এসব পারমাণবিক অস্ত্রের ভাগ্যে তাহলে কি ঘটবে?
নাকি বর্তমানে সেগুলো ব্যবহারের জন্য কেউ কেউ নিশপিশ করছেন? ইতোমধ্যে গাজা উপত্যকা থেকে সাড়ে এগার লক্ষ্য ফিলিস্তিনিকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে অন্যত্র সরে যাবার কড়া হুঁশিয়ারী দিয়ে ঘৃণ্য আক্রমণ চালাচ্ছে ইসরাইল!
পশিচমারা ইসরাইলের ব্যাপারে একপ্রকার অন্ধ মায়া দেখায়। তারা ইসরাইলের অন্যায় দখলদারিত্বকে কোন অন্যায়-অবিচার মনে করে না। সেখানে মানবতাবিরোধী ভূমিকা নিয়ে নৌবহর পাঠিয়ে হুমকি দিচ্ছে গণহত্যা সাধনের। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশে দূত বা টিম পাঠিয়ে মানবতা রক্ষা করার জন্য মিটিং করে চলেছে। ফিলিস্তিনি জনগণের উপর তাদের এই বৈপরিত্য ও অবিচার কেয়ামত পর্যন্ত চলবে বলে অনেকে মনে করছেন। অক্টোবর ২৮, ২০২৩ পর্যন্ত গাজায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে সাড়ে সাত হাজার এবং আহতের সংখ্যা অগণিত সংখ্যায় দাঁড়িয়েছে।
ইসরাইলীরা ভুলে গেছে যে তারা কয়েক দশক আগেও পৃথিবীতে নিজভূমিহারা হয়ে যাযাবর হয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছিল একটি বড় পাপের ফলে। তারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্যকারী ও গোঁয়ার্তুমির জন্য বেপরোয়া ঘৃণিত জাতি হিসেবে বিবেচিত। পবিত্র কোরআনে তাদের উপর মহান আল্লাহ বলেন, তাদের চুক্তি ও প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ, আল্লাহর আয়াতের সাথে কুফরী এবং অন্যায়ভাবে নবীদের হত্যা করার কারণে আল্লাহ তাদের অন্তরে গোমরাহির সিল মেরে দিয়েছেন। (সূরা নিসা : ১৫৫)। উপরোক্ত আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর প্রিয় নবীদের হত্যা করার জঘন্য তৎপরতা চালিয়ে তারা প্রমাণ করেছে, তাদের স্বার্থের পরিপন্থী যে কোনো লোককে হত্যা করা তাদের দ্বারা সম্ভব। নিষ্ঠুরতা ইহুদিদের প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি। তারা ২ জন নবীকে হত্যা করেছে এবং আরেকজনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে ব্যর্থ হয়। হযরত যাকারিয়া (আ:) এবং হযরত ইয়াহ ইয়া (আ:) – কে হত্যা করেছে। তাদের এই পৈশাচিক মনোভাব এখনও বিদ্যমান। তারা হযরত ইয়াহইয়া (আ:)-কে হত্যা করে তার ছিন্ন মস্তক তাদের বাদশাহর রক্ষিতাকে উপহার দেয়। স্বয়ং মুসা (আ:)-এর ওপর তারা ভীষণ নির্যাতন চালিয়েছে। হযরত ঈসা (আ:)-কে তারা ক্রশে বিদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছে। নাম না জানা আরো অনেক নবীকে তারা হত্যা করেছে।’
যুগে যুগে ইহুদিরা পৃথিবীর দেশে দেশে অশান্তি ও গোলযোগ সৃষ্টি করে থাকে। মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মধ্যে ঢুকে কুমন্ত্রণা দিয়ে তাদের বিভিন্ন সমস্যায় নিক্ষেপ করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চালায়। এ ব্যাপারে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, যখনই তারা যুদ্ধের আগুন জ্বালায়, আল্লাহ তা নিভিয়ে দেন এবং তারা যমীনে ফিতনা ফাসাদ ও গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। আল্লাহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের ভালোবাসেন না।’(সূরা মায়েদা : ৬৪)।
ইহুদীরা শেষ নবী এবং রাসুল হযরত মুহাম্মাদ (সা:) কে একাধিক বার চেষ্টা করেছিল। একবার আলচনার জন্য বসিয়ে রেখে পাথর ছুড়ে হত্যা করার চেষ্টা, আরেকবার মেহমানদারির মধ্যে বিষ যুক্ত খাবার পরিবেশন, আবার যাদু করা (এই প্রেক্ষিতে সুরা ফালাক ও সুরা নাস নাজিল হয়) । অত্যন্ত অপরাধ প্রবণ এই জাতি। পুরো আল কোরআনে এ একবারের জন্যও হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ শব্দটি আসেনি। কিন্তু অনেকবার বনী ইসরায়েল ও ইহুদী এসেছে। বনী ইসরায়েল হযরত মুসা (আ:) কেও অনেক কষ্ট দিয়েছে।’
আল্লাহ ইহুদিদের ওপর স্থায়ীভাবে লাঞ্ছনা, অপমান ও নির্যাতন নির্ধারিত করে দিয়েছেন। যুগে যুগে, ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে তাদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত করেছেন। মিসরের ফেরআউন শাইশাক জেরুসালেম দখল করে এবং ইহুদিদের তাড়িয়ে দেয়। তারপর ব্যাবিলনের রাজা বখতে নসর জেরুসালেম দখল করে ইহুদিদের বন্দি করে নিয়ে আসে এবং তাদের দাস বানিয়ে রাখে। পরে পারস্য সম্রাট ইহুদি দাসদের সেখানে ফেরত পাঠান সত্য, কিন্তু তখন পারস্য সম্রাটেরই অধীন ছিল। ৬৬ খ্রি. রোমান সম্রাট তাইতুস জেরুসালেম দখল করে এবং ইহুদিদের ব্যাপক হারে হত্যা করে। উপরন্তু ৭০ খ্রি. রোমান বাহিনী হাজার হাজার ইহুদিকে বন্দি করে নিয়ে যায় এবং তাদের দাস বানায়। এডলফ হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইহুদিদের হত্যা করেছিলেন। হিটলারের ইহুদিদের প্রতি ঘৃণার কারণ হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের জন্য ইহুদিদের দায়ী করার কথা বলা হয়।’
তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে গজবপ্রাপ্ত জাতি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী তাদের ধ্বংস অনিবার্য। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত হবে না যতক্ষণ না মুসলিমদের সঙ্গে ইহুদিদের যুদ্ধ হবে। মুসলিমরা ইহুদিদের হত্যা করতে থাকবে। তখন তারা (ইহুদিরা) পাথর ও গাছের পেছনে লুকিয়ে আশ্রয় নেবে। তখন পাথর ও গাছ বলবে, হে মুসলিম, হে আল্লাহর বান্দা, এই তো ইহুদি আমার পেছনে লুকিয়ে আছে। এসো, তাকে হত্যা করো।’(সহীহ মুসলিম)।
যা তারা জেনেও না জানার ভান করে আস্ফালণ করে থাকে। ১৯৪৮ সাল থেকে অন্যায়ভাবে ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি দখল করে হাজার হাজার নিষ্পাপ ফিলিস্তিনি নারী-শিশুদের অন্যায়ভাবে হত্যা করে তারা ক্রমাগত পাপাচারে লিপ্ত হয়েছে। তারা হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, শরণার্থী শিবির মসজিদ ইত্যাদির উপর নিষিদ্ধ বোমা বর্ষণ করে তিন হাজার হত্যা ও সাড়ে চারলক্ষ ফিলিস্তিনিকে ইতোমধ্যে উদ্বাস্তু করেছে। পানি, ওষুধ, খাদ্য প্রবেশের মূল রাস্তা বন্ধ। এগুলো কি চরম মানবিক অধিকার হরণ নয়?
ন্যাটো একতরফা ইসরাইলীদের পক্ষ নিয়েছে। জাতিসংঘ চেষ্টা করছে যুদ্ধ থামাতে কিন্তু পশ্চিমাদের কারণে পেরে উঠছে না। রাশিয়া ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলছে। ইরান, ইরাক, পাকিস্তান, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্ব ইসরাইলীদের এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে জোরালো প্রতিবাদ শুরু করেছে।
ইসরাইল যুদ্ধবন্ধ না করলে অথবা ন্যাটো দ্বিচারিতা বন্ধ না করলে ফিলিস্তিনিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে যে কোন পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাহলে অচিরেই সারাবিশ্বে মহাগোলযোগ শুরু হতে পারে। বিশ্বযুদ্ধের পাকানো সলতের মধ্যে কেউ আগুন ধরিয়ে দিলে গর্জে উঠবে চারদিক। যে যুদ্ধে কেউ জয়লাভ করবে না। যুদ্ধবাজরা বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করার সময় পাবে না। ফিলিস্তিন যতদিন নিরাপদ হবে না ততদিন ইসরাইল অনিরাপদ থেকেই যাবে। কেউ বিজয় উল্লাসে ফেটে উঠার আগেই মানবতার চরম পরাজয় সাধিত হয়ে সবকিছু নিথর হয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।

* রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.