সোমবার | ২০ অক্টোবর, ২০২৫ | ৪ কার্তিক, ১৪৩২

দাবি না মানলে নির্বাচনী দায়িত্ব বর্জন / তিন দফা দাবিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বিক্ষোভ মিছিল ও স্মারকলিপি প্রদান

ডেস্ক রিপোর্ট :

নাটোরের লালপুরে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়ি ভাতা, ১ হাজার ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা এবং কর্মচারীদের জন্য ৭৫ শতাংশ উৎসব ভাতাসহ তিন দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। একই সঙ্গে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর পুলিশের হামলা ও বলপ্রয়োগের নিন্দা এবং কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষিত লাগাতার কর্মবিরতি কর্মসূচির প্রতি সংহতি জানিয়ে তারা এই কর্মসূচি পালন করেন।
রোববার (১৯ অক্টোবর) সকাল ১১টার দিকে উপজেলার বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা উপজেলা চত্বর থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি গোপালপুর সিএনজি স্টেশন, রেলগেট ও নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস এলাকা ঘুরে পুনরায় উপজেলা চত্বরে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মিলিত হয়।
বেসরকারি কলেজ শিক্ষক-কর্মচারীদের তিন দফা দাবি আদায় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যক্ষ ড. মো. ইসমত হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও শিক্ষক নেতারা বক্তব্য দেন।
বক্তারা বলেন, “শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর সেই মেরুদণ্ডকে দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছেন দেশের বেসরকারি এমপিও ভুক্ত  শিক্ষকরা। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অবহেলায় তারা আজও বঞ্চিত।” তারা জানান, দেশের ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করছে, অথচ সেই শিক্ষকদের ন্যূনতম ভাতা ও সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না।
বক্তারা আরও বলেন, সরকারি চাকরিজীবীরা মূল বেতনের ৪৫-৫০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া, ১ হাজার ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, এমনকি লাঞ্চ, যাতায়াত ও বিনোদন ভাতাও পান। কিন্তু বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দেশ ও সরকারের আর্থিক বাস্তবতা বিবেচনা করে মাত্র ২০ শতাংশ বাড়ি ভাতা চেয়েছেন সেটাও দেওয়া হচ্ছে না। এতে শিক্ষক সমাজ গভীরভাবে হতাশ ও মর্মাহত।
তারা অভিযোগ করেন, এনটিআরসি-এর মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া অনেক শিক্ষক নিজ বাড়ি থেকে শত শত মাইল দূরে কর্মরত। মাসিক মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকার বেতনের সঙ্গে ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা দিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব। অথচ তাদের বেতন থেকেও ১০ শতাংশ কেটে রাখা হয়। বক্তাদের ভাষায়, “বাংলাদেশে কোথাও এক হাজার টাকায় ঘর ভাড়া বা ৫০০ টাকায় চিকিৎসা সম্ভব নয়।”
তারা বলেন, কর্তৃপক্ষকে বহুবার বিষয়টি অবহিত করা হলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং অনাবশ্যক প্রশিক্ষণ ও প্রকল্পের নামে সরকারি অর্থ অপচয় হচ্ছে, যার ৭০ শতাংশই কর্মকর্তাদের পেছনে ব্যয় হয়। শিক্ষক বা শিক্ষার্থীরা তাতে খুব একটা উপকৃত হন না। তাই অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাতিল করে শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান তারা।
শিক্ষক নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “শিক্ষকদের প্রতি সরকারের এই বৈষম্য বন্ধ না হলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা টেকসই হবে না। আমাদের দাবি ন্যায্য বাস্তবায়ন করতে হবে।”
তারা আরও বলেন, রাজপথ তাদের জায়গা নয়। তারা শ্রেণিকক্ষে ফিরে যেতে চান। তবে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে কোনো দায়িত্ব পালন করবেন না বলে হুঁশিয়ারি দেন শিক্ষক নেতারা।
সমাবেশ শেষে শিক্ষকরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মাজার শরীফ বিজনেস ম্যানেজমেন্ট টেকনিক্যাল উইমেন্স কলেজের অধ্যক্ষ ইমাম হাসান মুক্তি, মঞ্জিল পুকুর কৃষি কারিগরি ও বাণিজ্যিক মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. সাইফুল ইসলাম রিপন, মোহরকয়া ডিগ্রি পাস ও অনার্স পাস কলেজের অধ্যক্ষ ড. ইসমত হোসেন, মমিনপুর মাজার শরীফ দাখিল মাদ্রাসার সুপার এএসএম মোকাররমুর রহমান নাসিম, পাইকপাড়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার আবুল কালাম আজাদ, ভেল্লাবাড়িয়া বাগুদেওয়ান আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জয়তুননেসা, রহিমপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান মো. মাবুদ আলী সহ উপজেলার বিভিন্ন স্কুল থেকে আসা শিক্ষক কর্মচারীবৃন্দ।
উল্লেখ্য, গত ১৩ অক্টোবর থেকে সারা দেশের ন্যায় লালপুর উপজেলাতেও বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কর্মবিরতি পালন করছেন। এতে শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে।
এর আগে ১২ অক্টোবর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধিসহ ৩ দফা দাবিতে ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। রাজধানীর শাহবাগ, প্রেস ক্লাব ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনে শিক্ষকরা বিক্ষোভ করেন। প্রথম দিন থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মবিরতি ও ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
১৩ অক্টোবর দ্বিতীয় দিনে আন্দোলন আরও ব্যাপক রূপ নেয়। সারাদেশের শিক্ষকরা নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস বর্জন করে একাত্মতা প্রকাশ করেন। কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি চলে টানা কয়েক ঘণ্টা।
১৪ অক্টোবর তৃতীয় দিনে শাহবাগ এলাকায় শিক্ষক-কর্মচারীরা অবস্থান নিয়ে “সচিবালয় অভিমুখে পদযাত্রা”র ঘোষণা দেন। আন্দোলনকারীরা সরকারের প্রতি ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে বলেন—দাবি বাস্তবায়নের গেজেট প্রকাশ না হলে তারা সচিবালয় অভিমুখে যাত্রা করবেন।
১৫ অক্টোবর চতুর্থ দিনে ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোট’-এর ব্যানারে শিক্ষকরা রাজধানীতে গণসমাবেশ করেন। তারা দুপুর ১২টার মধ্যে সরকারের সিদ্ধান্ত চেয়ে আল্টিমেটাম পুনর্ব্যক্ত করেন। দিনজুড়ে ক্লাস বর্জন অব্যাহত থাকে।
১৬ অক্টোবর আন্দোলনের পঞ্চম দিনে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে আংশিক সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষকরা ব্যানার-ফেস্টুন হাতে “দাবি মানতে হবে” শ্লোগান দেন। এদিন পুলিশের সঙ্গে কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
১৭ অক্টোবর ষষ্ঠ দিনে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় শিক্ষকরা সারাদিন অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। অনেকেই অনশন কর্মসূচি শুরু করেন। সরকারের সঙ্গে আলোচনার কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় তারা আন্দোলন আরও জোরদার করার ঘোষণা দেন।
১৮ অক্টোবর সপ্তম দিনে শিক্ষকরা কালো পতাকা ধারণ কর্মসূচি পালন করেন। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সমাবেশ ও মানববন্ধন হয়। পরদিন সরকার ঘোষিত সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণের কথা জানানো হয়।
আজ রবিবার অষ্টম দিনে সরকারের উপসচিব মিতু মরিয়মের স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে ৬ শর্ত সাপেক্ষে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া ভাতা মূল বেতনের ৫ শতাংশ হারে (সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা) দেওয়া হবে জানিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় যা কার্যকর হবে আগামী ১ নভেম্বর থেকে। তবে শিক্ষক-কর্মচারীরা এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। পরে বিকেলে তারা রাজধানীতে থালা হাতে ভুখা মিছিল করেন।

সম্পাদনায়: রাশিদুল ইসলাম রাশেদ

সাব এডিটর, প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.