শুক্রবার | ২২ নভেম্বর, ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১

ভোটের মাঠে আ.লীগের দৌড়ঝাঁপ, বিরোধীরা চুপচাপ ঘরোয়াভাবে সক্রিয়

আনোয়ারা খাতুন শেফালী, লালপুর (নাটোর) প্রতিনিধি
জাতীয় সংসদের আসন ৫৮ নাটোর-১ লালপুর ও বাগাতিপাড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক দৌড়ঝাঁপসহ নানা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। বিরোধীরা দল ও জোটের প্রার্থীরা চুপচাপ ঘরোয়াভাবে সক্রিয় কৌশলী ভূমিকা পালন করছেন।
বুধবার (১৫ নভেম্বর ২০২৩) সন্ধ্যায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। তফসিল অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন নির্ধারণ করেছে নির্বাচন কমিশন। মনোনয়ন দাখিলের শেষ সময় ৩০ নভেম্বর, মনোনয়ন যাচাই-বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর, মনোনয়ন বাতিলের বিরুদ্ধে আপিল ও নিষ্পত্তি ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহার ১৭ ডিসেম্বর, প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর, নির্বাচনী প্রচার চলবে ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত।
এই আসনে রাজনৈতিক সহিংসতা বিরাজমান। বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পর বিরোধী প্রতিহিংসা ও নিজ নিজ দলীয় কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। সাবেক সংসদ সদস্য মমতাজ উদ্দিন, আখচাষী নেতা আব্দুস সালামসহ বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী খুনের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমান রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলে দলীয় অন্তদ্বন্দ্ব বিরাজমান। প্রতিটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুল ও সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ অনুসারীদের পৃথক কমিটি রয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্মসূচি লালপুরে চারভাগে এবং বাগাতিপাড়ায় তিনভাগে পালিত হয়। বিএনপিতে উপজেলা কমিটি নিয়ে বিরোধে আলাদা কর্মসূচি হয়। প্রকাশ্যে নির্বাচনী তৎপরতা না থাকলেও বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীরা ঘরোয়াভাবে সক্রিয় রয়েছেন।
বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থী:
এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন, বর্তমান সংসদস সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শহিদুল ইসলাম বকুল; সাবেক সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাড. আবুল কালাম আজাদ; লালপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহম্মেদ সাগর; সাবেক সাধারন সম্পাদক ও লালপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. ইসাহাক আলী; বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও বঙ্গবন্ধু প্রবীণ জোট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কর্নেল (অব.) মো. রমজান আলী সরকার; জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. আনিসুর রহমান; আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপকমিটির সদস্য সিলভিয়া পারভিন লেনি; কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আতিকুল ইসলাম আতিক; কেন্দ্রীয় উপকমিটির বন ও পরিবেশ বিষয়ক সদস্য আরিফুল ইসলাম উজ্জল; জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক কাজল রায়, বাগাতিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য মো. রওশন আলম সুরুজ প্রমুখ।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) থেকে প্রচারণায় রয়েছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী, উপজেলা বিএনপির সদস্য, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান পটলের স্ত্রী কামরুন্নাহার শিরিন; কেন্দ্রীয় কমিটির সহদপ্তর সম্পাদক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মো. তাইফুল ইসলাম টিপু; কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া প্রমুখ।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের (গামছা) ও নাটোর জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মনজুরুল ইসলাম বিমল। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন বাংলাদেশের ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য মুহাম্মাদ খালেকুজ্জামান ও ঢাকা মহানগর উত্তরের প্রচার ও দাওয়াহ বিষয়ক সম্পাদক মো. গিয়াস উদ্দিন পরশ। জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এম এ তালহা; ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও নাটোর জেলা শাখার সভাপতি, উত্তরবঙ্গ আখ চাষী সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খলিল; বাংলাদেশ বিপ্লবী কৃষক সংহতির সভাপতি ও বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির (কোদাল) কেন্দ্রীয় পলিট ব্যুরো সদস্য আখচাষী নেতা আনছার আলী দুলাল; সাম্যবাদী দল (এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বীরেন্দ্রনাথ সাহা প্রমুখ। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলের (এনডিএম-সিংহ মার্কা) কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য মো. মাকসুদুর রহমান। জাসদ (ইনু) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মো. মোয়াজ্জেম হোসেন; জামায়াতে ইসলামী লালপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে।
নির্বাচনী কথা:
১৯৭০ সালে বৃহত্তর রাজশাহী-৮ (এনই-৩৭, লালপুর-চারঘাট) নির্বাচনী এলাকায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সৈয়দ নাজমুল হক সরকার। একই সময় প্রাদেশিক পরিষদে লালপুর-চারঘাট আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের মো. জিল্লুর রহমান ওরফে জুল্লুর। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ (১৯৭৩-১৯৭৫) নির্বাচনে ৫৫ রাজশাহী-১৪ (লালপুর-চারঘাট) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. মো. আলাউদ্দিন নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন।
১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নবগঠিত নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনে বিএনপি প্রার্থী আব্দুল মান্নান ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদের হুইপ নিযুক্ত হন। ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মো. মমতাজ উদ্দিন রিকসা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির নওশের আলী বাদশা লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন।
১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিতর্কিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা চার বার বিএনপি প্রার্থী ফজলুর রহমান পটল ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী, যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির ফজলুর রহমান পটল ৭০ হাজার ৬৪৬ ভোট; আওয়ামী লীগের মমতাজ উদ্দিন ৪০ হাজার ২৬৪ ভোট। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচনে বিএনপির ফজলুর রহমান পটল ৭৮ হাজার ৮৯৭ ভোট; আওয়ামী লীগের মমতাজ উদ্দিন ৬২ হাজার ১৮৪ ভোট। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির ফজলুর রহমান পটল ৯৯ হাজার ৫৯১ ভোট; আওয়ামী লীগের মমতাজ উদ্দিন ৮৯ হাজার ৯৪৮ ভোট।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ (২০০৮-২০১৩) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির এম এ তালহা লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে ১ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৫ ভোট সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিএনপির ফজলুর রহমান পটল ১ লাখ ৩ হাজার ৮১৪ ভোট।
২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদে বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন ও প্রার্থীতা প্রত্যাহার করায় আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী হিসেবে মো. আবুল কালাম আজাদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৮ নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনে আওয়ামী লীগের শহীদুল ইসলাম বকুল নৌকা প্রতীকে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৪৪০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কামরুন নাহার শিরিন (ধানের শীষ-বিএনপি) ১৫ হাজার ৩৩৮ ভোট।
প্রার্থীদের বক্তব্য:
বর্তমান সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুল বলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। যার মর্যাদা তিনি রেখেছেন। তাঁর সময়ে এলাকার রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এই জনপদে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, নৈরাজ্য, রাজনৈতিক সংঘাত দূর হয়েছে। মানুষ শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারছে। তাঁকে পূনরায় নৌকা প্রতীক দেওয়া হবে।
সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, গত নির্বাচনে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া না হলেও রাজনৈতিক সকল কর্মকান্ডে তিনি সম্পৃক্ত রয়েছেন। মনোনয়ন প্রত্যাশায় নির্বাচনী জনসংযোগ, উঠান বৈঠক অব্যাহত রেখেছেন। তিনি দাবি করেন দুই উপজেলার তৃণমূল নেতা-কর্মী তাঁর সাথে আছেন। চ্যালেঞ্জিং নির্বাচন হিসেবে নেত্রী তাঁকেই এবার নৌকা প্রতীক দেবেন।
লালপুর উপজেলা বিএনপির সদস্য ও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী কামরুন্নাহার শিরিন বলেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে হলেই আমরা নির্বাচনে যাব। এ দাবি পূরণ হলে মনোনয়ন চাইব। আমি মনে করি, এই আসনের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী-ভোটাররা আমার পাশে আছেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। দলীয় কর্মসূচি ও প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.