-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম :
নতুন বছরের প্রথম দিনেই আঘাত হানা সিরিজ ভূমিকম্পে ৭৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। জাপানের প্রধান দ্বীপ হোনশু-র ইশিকাওয়া জেলায় ৭ দশমিক ৬ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। এই ভূমিকম্পের জেরে দেশটিতে সুনামির আশঙ্কা দেখা দেয়। ভূমিকম্পের ১০ মিনিটের মধ্যে ১২ ফুট উচ্চতার ঢেউ আঘাত হানে ইশিকাওয়ার ওয়াজিমা শহরে। ভূমিকম্পে অন্তত ৫০টি ভবন ধসে পড়ে ও ৩৫ হাজার ঘরবাড়ি ভেঙ্গে যায়। ওয়াজিমা শহরে মাত্র ৫ ঘণ্টার ব্যবধানে ১৫৫টির মতো ‘আফটার শক’ অনুভূত হয়। ভূমিকম্পের আঘাতে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দেশটির ইতিহাসে এবারের ভূমিকম্পকে অন্যতম বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। জাপানি মিথ বা পৌরানিক কেচ্ছার বিশ্বাস অনুযায়ী, এত বড় দুর্যোগ কোনো সংকেত ছাড়াই চলে আসেনা।
এছাড়া ভূমিকম্পের পরদিন টোকিও শহরের কোল ঘেঁষে সমুদ্রের উপর নির্মিত হানেদা বিমানবন্দরের রানওয়েতে বিমান দুর্ঘটনা ঘটে।
আগে এই হানেদা বিমানবন্দরের পরিধি ছোট ছিল। এর রানওয়ের সম্প্রসারণ করা হয়েছিল টোকিও শহরের গার্বেজকে সমুদ্রের উপর ফেলে ভরাট করে উঁচু করে করে। হানেদায় টার্মার্ক নির্মিত হয়েছিল অত্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। তবুও টোকিওর হানেদার বড় বড় বিমানের জায়গা সংকুলান না হওয়ায় পরবর্তীতে পাশের চিবা জেলায় কৃষকদের আবাদী জমি অধিগ্রহণ করে নির্মিত হয়েছে নিউ টোকিও ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট (নারিতা)নামক আরেকটি নতুন বিমানবন্দর। নারিতায় আর্ন্তজাতিক রুটের বিদেশী বিমান বেশী অবতরণ করে।আজকাল হানেদায় জাপানের অভ্যন্তরীণ বিমানের অবতরণ বেশী হয়।
ভূমিকম্পের পরদিন হানেদা বিমানবন্দরের রানওয়েতে দুটি বিমানের সংঘর্ষে একটি কার্গো বিমানের পাঁচ জন মারা গেছেন ও এয়ারবাসের সকল যাত্রী রক্ষা পেয়েছেন। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় জাপান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান অবতরণের সময় রানওয়েতে পার্ক করে রাখা আরেকটি বিমানের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এতে দুটি বিমানেই আগুন ধরে যায়।
আগুন ধরা অবস্থাতেই জাপান এয়ারলাইন্সের বিমানটি রানওয়েতে অবতরণ করে। মুহূর্তেই পুরো রানওয়ে কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। জাপান এয়ারলাইন্সের এয়ারবাস এ৩৫০ উড়োজাহাজে সে সময় ৩৭৯ জন আরোহী ছিলেন, যাদের মধ্যে আটজন ছিল শিশু। তবে তাদের সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। এত ভয়ংকর দুর্ঘটনায় বিমানে আগুন লাগার পরও অতি দ্রুত সকল যাত্রীকে নিরাপদে বিমান থেকে নামিয়ে আনার জন্য সুপ্রশিক্ষিত জাপানী বিমানক্রুদের প্রশংসা করছেন বিশ্ববাসী।
তবে আধুনিক বিজ্ঞানমনষ্ক জাপানীদের মাঝেও মিথ বা কেচ্ছা-কাহিনী অনেক। সেদেশে অনেকেই ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী না হলেও তারা কিছু কিছু প্রাকৃতিক শক্তিকে মনে প্রাণে শ্রদ্ধা করে থাকেন। প্রচলিত মিথ মেনে অনেকেই বিড়াল, বানর, গাছ, ব্যাঙ, সাপ, মাছ, ড্রাগণ ইত্যাদিকে শ্রদ্ধা করে বাড়ির সামনে দামী পাথর বা কাঠ দিয়ে সেগুলোর প্রতিকৃতি বানিয়ে কাঞ্জিতে নাম লিখে সাজিয়ে রাখেন। তাদের নান ধরণের ‘কামি-সামা’ দেবতা বা ‘গড’ বিশ্বাস আছে। ‘কামি-সামা’ জাপানীজ ভাষার কাঞ্জিতে (神様) হল “দেবতা” যিনি বা যারা স্বর্গ ও পৃথিবীর শাসক ! এই বিশ্বাসের ফলে উল্লিখিত প্রাণি বা বস্তুগুলোকে গডের বার্তাবাহক হিসেবে মনে করা হয় অনেক অঞ্চলে।
কোন কোন জাপানির মধ্যে মিথ, পূর্বসংস্কার বা বদ্ধমূল ধারণা খুব প্রকট। নতুন বছরের ভূমিকম্পের পর অরফিস বা জাপানী ভাষায় ‘রিউগো নো সুকাই’ নামে ডাকা একটি মাছ নিয়ে বদ্ধমূল ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেক জাপানীদের মাঝে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে ।জাপানিরা অরফিশকে ‘রিউগো নো সুকাই’ নামে ডাকে। এই নামের অর্থ হলো, সমুদ্র দেবতার রাজপ্রাসাদ থেকে বার্তাবাহক।হয়তো এই বৃহৎ মাছটি ছিল সেই ধরণের এক বার্তাবাহক। সে হয়তো ভূমিকম্পের ভবিষ্যৎবাণী নিয়ে এসেছিল।
ইংরেজিতে হেরিং প্রজাতির মাছটির প্রচলিত নাম অরফিশ। গভীর সমুদ্রে, যেখানে সূর্যের আলো পর্যন্ত পৌঁছায় না—এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে এটি বসবাস করে। তাই সহজে মাছের দেখা পাওয়া কঠিন। গত গ্রীষ্মে এই অরফিশ-এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ডুবুরিদের। মাছ হলেও এটি দেখতে অনেকটা চ্যাপ্টা সাপের মতো।‘এই মাছ দৈর্ঘ্যে ৩০-৪০ ফুট হতে পারে। বিশাল আকৃতির জন্য অনেকে এই মাছকে ‘দানব’ হিসেবে আখ্যা দিলেও ‘ডোমস ডে ফিশ’ বা কেয়ামতের মাছ হিসেবেও এটির বিশেষ খ্যাতি রয়েছে।’ এবছর জানুয়ারির প্রথম দিনে জাপানের ইশিকাওয়ার ওয়াজিমা শহরে ঘটা ভূমিকম্পের সঙ্গেও অনেকে এই দানব মাছটির সম্পর্ক দেখছেন ।
গণমাধ্যমে জানা গেছে, ‘সম্প্রতি তাইওয়ান উপকূলে একটি অরফিশ গভীর জল থেকে ওপরের দিকে উঠে এলে এটি ডুবুরিদের নজরে পড়ে। জাপানের ভূমিকম্পের জন্য এটিকে একটি পূর্বসংকেত হিসেবে চিহ্নিত করছেন অনেকে।’
জাপানি বিশ্বাস অনুযায়ী, এত বড় দুর্যোগ কোনো আগাম সংকেত ছাড়াই সাধরণত ঘটে না। তাই গত গ্রীষ্মে দেখা পাওয়া সেই অরফিশকেই টেনে আনা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে টুইটারে এ বিষয়ে অনেকে নিজেদের মতামত দিচ্ছেন। এসব টুইট থেকে জানা গেছে, ২০১১ সালে জাপানে ভূমিকম্পের জেরে যে প্রলয়ংকরী সুনামির সৃষ্টি হয়েছিল, তার আগের বছরটিতে ডজনখানেক অরফিশ সমুদ্রের তীরে ভেসে এসেছিল।
তবে সমুদ্রের গভীর থেকে অরফিশ ভেসে আসার সঙ্গে ভূমিকম্পের সম্পর্ক আছে কি না, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
ভূমিকম্পে জাপানের মধ্যাঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দেশটিতে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এরপর আফটার শক্ মিলিয়ে মোট ১৫৫টি কম্পন হয়েছে। এসব ভূমিকম্পে জাপানে বহু ভবন ধসে পড়েছে। বিদ্যুৎহীন অনেক এলাকা। ফাটল ধরেছে সড়কে।সেই সড়কের ফাটলে গাড়ি আটকে গেছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন অনেক মানুষ। ইশিকাওয়া অঞ্চলের আনামিজু শহরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একটি ওষুধের দোকান। গণমাধ্যমে দেখা গেছে দোকানের মালিকের অনুমতির পর সেখান থেকে বিনা মূল্যে পানি, ওষুধের বোতল ও নানা দরকারী পণ্য নিচ্ছিলেন লোকজন্।
ভূমিকম্পের দেশ হলো জাপান। সেখানে হাজারো সুপ্ত আগ্নেয়গিরির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপে, ডুবো সমুদ্রচরে প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ছোট ছোট ভূমিকম্প হতে দেখা যায়।তাই সেগুলো নিয়ে কেউ তেমন বিচলিত হন না। তবে সেসব দূরবর্তী ক্ষুদ্র দ্বীপে বসবাসকারী মানুষেরা সমুদ্রদেবতাকে গভীরভাবে বিশ্বাস করে থাকেন।সেই বিশ্বাস মনে নিয়ে জাপানী জেলেরা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে নেমে পড়েন।অশতীপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধারও সমুদ্রতটের কাছে লাল কাকড়া ধরেন, ওয়েষ্টার, সীবাস, প্লাঙ্কটন দিয়ে মজাদার খাবার তৈরী করে বিক্রি করেন। সেখানে মহিলা ডাইভাররা দু:সাহসিকভাবে গভীর সমুদ্রে ডাইভ দিয়ে ঝিনুক, ওয়েষ্টার ইত্যাদি আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।আমাদের দেশে পুরুষ ডাইভাররা এই মাইল পানির নিচে দীর্ঘ সময় ডুবে ডুবে সামুদ্রিক ফুড আহরণের জন্য যে সৎসাহস দেখাতে পারবেন না ক্ষুদ্র দ্বীপের জাপানি মহিলা ডাইভাররা প্রযুক্তি ব্যবহার করে অত্যন্ত নিপুণভাবে সেসব কাজগুলোকে তাদের দৈনন্দিন সূচিতে পালন করে থাকেন।
আমাদের দেশের মতো এত সহজ শ্রমবাজার ওদের দেশে নেই। শিল্পকারখানায় কাজ করার সময় সেখানে কেউ একমিনিটও ফাঁকি দেন না। আবার কৃষিকাজে প্রকৃতির সাথে সবাইকে লড়াই করতে হয়।গ্রীণ হাউসে একটি শশা বা টমেটো ফলাতে তাদেরকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি অগ্নুৎপাত, সুনামি, তুষারপাতে হোক্কাইডো-সাপ্পোরোর ঠান্ডা, ওকিনাওয়ার গরম, সারা জাপানে ঘন ঘন টাইফুন লেগেই আছে। কিন্তু এসবকিছুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার জন্য তাদের মনোবল অতি প্রবল। প্রাকৃতিক বিপর্যয় তাদের বেশীক্ষণ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে না।কারণ, তারা দ্রুত গবেষণা করে যে কোন সমস্যার একটা একটা উপায় বের করে ফেলে। সেই গবেষণালব্ধ ফলাফল দিয়ে তারা প্রশিক্ষণ দেয় ও প্রশিক্ষণ নেয়। যার ফলে দেখা গেল একিট যাত্রীভির্তি এয়ারবাসে আগুন লাগলেও অত্যন্ত ধৈর্য্য সহকারে মাত্র ৫-৭ মিনিটের মধ্যে সুশৃংখলভাবে একটি দরজা ব্যবহার করে নিরাপদে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছিল।
নিজের জীবনের মায়া উপেক্ষা করে অগ্নিদগ্ধ বিমানের সব যাত্রীকে বের করে আনার পর সবার শেষে ক্রুরা বিমান থেকে বের হয়েছিল। জাপানী বিমানক্রুদের সঠিক প্রশিক্ষণ ও পেশাদারী ত্যাগী মনোভাব সবাইকে একটি বড় শিক্ষা দেয়। পেশাদারী একাজে তাদের কোন মিথ নির্ভরতা ছিল না।
তবে ওয়াজিমা ভূমিকম্পের পর অরফিশের বার্তাকে শুধু মিথ বা কেচ্ছা-কাহিনী মনে না করে তারা ভূমিকম্পের সংকেত হিসেবে গবেষণার্ জন্য প্রাকৃতিক উপাত্ত হিসেবে মনে করতে পারে। কারণ প্রাণির আচরণগত বিষয় হওয়ায় এটা একটি প্রকৃতি পাঠ। প্রকৃতি পাঠের সবকিছুকে একবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
এই বদ্ধমূল ধারণার মতো শত মিথ, ট্যাবু, টোটেম ভূমিকম্প গবেষণার সহযোগী উপাত্ত হিসেবে কাজে লাগুক।
‘যাহা রটে তাহা বটে’-এই প্রবাদ আর গভীর সমুদ্র ছেড়ে হঠাৎ অরফিসের উপকূলে আগমনের মাধ্যমে পূর্ববতী ভূমিকম্পের ঘটনসংখ্যাগুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখা উপস্থাপন করার কথা অদ্যাবধি হাস্যকর শোনালেও বিজ্ঞান একদিন সেটা প্রমাণ করতেও পারে।অরফিশের মিথ অদুর ভবিষ্যতে উন্নত গবেষণার মাধ্যমে যথাযথ পূর্বাভাস জেনে ভূমিকম্প প্রতিরোধে বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যাখ্যা নিয়ে এগিয়ে আসার সুযোগ লাভ করুক। কোনরকম আগাম বার্তা ছাড়াই ভূমিকম্পের আকস্মিক ধ্বংসলীলার ভয় থেকে মুক্তি পাক গোটা বিশ্বের মানুষ।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]