সোমবার | ৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ | ২৩ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

লালপুরে ভেজাল গুড়ের কারখানায় অভিযান: কারখানা মালিককে জরিমানা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

নাটোরের লালপুরে আখের গুড় তৈরির নামে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও পচা চিটাগুড় ব্যবহার করে ভেজাল গুড় উৎপাদনের অভিযোগে এক কারখানা মালিককে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সোমবার (৮ ডিসেম্বর, ২০২৫) বিকেলে উপজেলার বালিতিতা ইসলামপুর গ্রামে এ অভিযান পরিচালনা করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবীর হোসেন।

জানা গেছে, স্থানীয় সাগর আলী (২৮) নামের ওই কারখানা মালিক আ. মালেকের ভাগ্নে। তার কারখানায় দীর্ঘদিন ধরে নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে গুড় উৎপাদন করা হচ্ছিল।
অভিযান পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, কারখানায় তল্লাশির সময় কাপড় রং করার রাসায়নিক, হাইড্রোজ (সোডিয়াম হাইড্রো সালফাইট), ময়দা, ডালডা ও গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত চিটাগুড়সহ বিপুল পরিমাণ ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া যায়। এগুলো দিয়ে আখের ভেজাল গুড় তৈরি করা হচ্ছিল। পরে ভেজাল গুড় ও উপকরণ জব্দ করে ধ্বংস করা হয় এবং সাগর আলীর কাছ থেকে এক লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
অভিযানে লালপুর থানা পুলিশ ও আনসার সদস্যরা উপস্থিত থেকে সহযোগিতা করেন।
এর আগে ২ ডিসেম্ব একই এলাকায় পরিচালিত অভিযানে ওমর আলী নামের আরেক ব্যক্তিকে পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সে সময়েও বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক উপাদান ও প্রস্তুত ভেজাল গুড় ধ্বংস করা হয়।
এদিকে, আজই উপজেলায় শীত মৌসুমে খেজুরের গুড়কে ভেজালমুক্ত রাখতে করণীয় নির্ধারণে এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘নিরাপদ খাদ্য আমাদের অধিকার’—এই স্লোগানকে সামনে রেখে সিসিডিবি-সিপিআরপি ঈশ্বরদীর সহায়তায় উপজেলা  সদরের ফুড প্যালেস রেস্টুরেন্টে এ মতবিনিময় সভা হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন সিসিডিবি লালপুর উপজেলা নেটওয়ার্কের সভাপতি পারুল আকতার। প্রধান অতিথি ছিলেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. মোখলেছুর রহমান।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন জাতীয় কৃষি আনন্দ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডভোকেট শফিকুর রহমান, নিরাপদ খাদ্য উদ্যোক্তা ও প্রাকৃত কৃষিজ নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা ব্রাত্য আমিন, ক্যাবের নাটোর জেলা সভাপতি শামীমা লাইজু নীলা, রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম, সিসিডিবি ঈশ্বরদী এরিয়া ম্যানেজার কাওছার আল মামুন, কো-অর্ডিনেটর মারজিয়া প্রভা ও ডেনিস মাকান্দী, সমাজ সংগঠক ইকবাল হোসেন, শিক্ষক শহিদুল ইসলাম এবং সাংবাদিক ইমাম হাসান মুক্তি, মোজাম্মেল হক ও শাহ আলম সেলিম।
বৈঠকে সিসিডিবি নেটওয়ার্কভুক্ত ২৬টি সংগঠনের প্রতিনিধি ছাড়াও সচেতন নাগরিক, গুড় উৎপাদক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অর্ধশতাধিক মানুষ অংশ নেন।
মূল প্রবন্ধে তুলে ধরা হয়, নাটোর জেলায় বছরে প্রায় ৯ হাজার ৬২৩ টন গুড় উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে লালপুরের খেজুর গাছ থেকেই আসে প্রায় ৫ হাজার ৭৯ টন। উৎপাদিত এসব গুড়ের বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১০৫ কোটি টাকা। অথচ লালপুর এলাকায় শতাধিক ভেজাল গুড় তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে—যেখানে ক্ষতিকর রাসায়নিক হাইড্রোজ, ফিটকারি, রংসহ নানা উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে খেজুর রস ছাড়াই ভারত থেকে পশুখাদ্য হিসেবে আমদানি করা নিম্নমানের চিনি, ময়দা ও রাসায়নিক মিশিয়ে বানানো হচ্ছে গুড়।
উৎপাদকরা জানান, খাঁটি রসের তুলনায় চিনি দিয়ে গুড় তৈরি করলে কেজিপ্রতি প্রায় ৫০ টাকা বেশি মুনাফা পাওয়া যায়। বর্তমানে লালপুরের প্রায় ৩০টি গ্রামে এ ধরনের ভেজাল গুড় উৎপাদন চলছে। চিনি দিলে গুড় শক্ত হয়, সহজে ভাঙে না—এ কারণে বাজারে দেখতে আকর্ষণীয় হওয়ায় ভেজাল গুড়ের চাহিদা তুলনামূলক বেশি বলেও তারা জানান। পাশাপাশি রঙ উজ্জ্বল করতে কমলা-লাল রং, চুন, ফিটকারি, সুগার মিলের লালি ও মেয়াদোত্তীর্ণ চিনির পচা সিরা ব্যবহার করা হয়।
বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা বলেন, দীর্ঘদিন এসব ভেজাল গুড় খেলে লিভার ও স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা, এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকি পর্যন্ত তৈরি হতে পারে। নিরাপদ খাদ্য অধিকার একটি মৌলিক মানবাধিকার উল্লেখ করে তারা বলেন, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ অনুযায়ী ভেজাল খাদ্য উৎপাদন কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। খাদ্যে ক্ষতিকর উপাদান মেশালে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এছাড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনেও নিষিদ্ধ উপাদান মিশ্রণের বিরুদ্ধে শাস্তির কথা বলা আছে; ভোক্তারা চাইলে সরাসরি অভিযোগও করতে পারেন।
বৈঠকে বক্তারা খেজুর গুড়ের শতবর্ষী ঐতিহ্য রক্ষায় প্রশাসন, ব্যবসায়ী, উৎপাদক ও নাগরিক সমাজকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।

সম্পাদনা : রাশিদুল ইসলাম রাশেদ /উপসম্পাদক /প্রাপ্তি প্রসঙ্গ/০৮-০১

স্বত্ব: নিবন্ধনকৃত @ প্রাপ্তিপ্রসঙ্গ.কম (২০১৬-২০২৩)
Developed by- .::SHUMANBD::.