-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে কিছু বিশেষ চাকুরে বা সরকারী বেতনভূক মানুষের বদলী নিয়ে বিশেষ তৎপরতা চালাতে দেখা যায়। যে মানুষগুলো প্রার্থীদেরকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকেন বলে লোকমুখে শোনা যায় এবং অনেক সময় গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। তবে শুধু জানা-শোনার ব্যাপার নয়, এটা নিয়ে আমাদের দেশে নির্বাচনী সংস্কৃতিতেও সাড়াজাগানো বদ্ধমূল ধারণা আছে। এই ধারণার কারণ হলো তারা পক্ষপাতিত্ব করে যে কোন প্রার্থীকে জিতিয়ে দিতে পারেন। অথবা নানাভাবে জিতিয়ে দিয়েছেন বলে প্রচলিত একটা বড় সন্দেহ জনমন থেকে জনপ্রশাসন পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। পক্ষপাতিত্বমূলক সন্দেহ থেকে এবারের জাতীয় নির্বাচনের আগে তাদের বদলীর বিষয়টি ইতোমধ্যে নির্বাচনী মাঠ গরমের স্থান দখল করে ফেলেছে।
এবছর নির্বাচনের আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে একবছরের অধিক সময় কোন কর্মস্থলে কর্মরত ইউএনও-দেরকে এবং ছয় মাসের অধিক সময় কোন কর্মস্থলে কর্মরত থানার ওসি-দেরকে বদলী করেছেন। ইতোমধ্যে ২০৫ জন ইউএনও এবং ৩৩৮ জন ওসিকে বর্তমান কর্মস্থল থেকে অন্যত্র বদলী করে প্রজ্ঞাপণ জারি করা হয়েছে। কোন কোন জেলায় এসপিদের বদলী করার দাবী উঠেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এরুপ বদলীকরণ প্রক্রিয়া আমাদের দেশে নির্বাচনী কৃষ্টির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
সাধারণত: যারা নির্বাচনকে নিরাপত্তা দেন অথবা মাঠ পর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য সরাসরি নিরাপত্তামূলক কাজের আঞ্জাম, সকল উপাদানের সংরক্ষণ, সঞ্চালন, পরিবহন, প্রকাশন ইত্যাদির সংগে সরাসরি জড়িত থাকেন তাদের উপর গভীর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। সেজন্য তাদের সাথে প্রার্থীর পূর্ববন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, বা কোন ধরনের দহরম-মহরম থাকার ইতিহাস-উদাহরণ কিছুই থাকে না বলে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু আজকাল এসবের কোনটিরই কোন গ্যারান্টি নেই বিধায় সন্দেহের উর্দ্ধে উঠে গভীর আস্থার সাথে নির্বাচনের মতো একটি পবিত্র কাজকে পরিচালনা করা দূরুহ হয়ে উঠেছে। তবুও এক ধরনের ‘আই-ওয়াস’-এর মতো নির্বাচনের আগে প্রতিপক্ষগুলোকে পারস্পরিক আস্থার নিরপেক্ষতা বোঝানোর জন্য বদলী নামক কাজটি করতে হয়।
কিন্তু গতানুগতিক কায়দায় বদলী প্রক্রিয়া সেরে নেয়ার প্রবণতা আরো বেশী পক্ষপাতিত্ব ও সন্দেহের উদ্রেক তৈরী করে ফেলেছে। ইতোমধ্যে বদলী কার্যকর হতে শুরু করেছে। এই প্রক্রিয়ার প্রথমসারির চাকুরেদের মধ্যে জেলা-উপজেলা বা থানা পর্যায়ের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যাক্তিকে ইতোমধ্যে নিজ কর্মস্থল থেকে সরিয়ে নতুন কর্মস্থলে পাঠানো হয়েছে। হয়তো আরো অনেককে সরাতে হবে। আপাত:দৃষ্টিতে এটি একটি ‘মন্দের ভাল’প্রক্রিয়া- যা জনমনে সন্দেহ কমাতে পারে বলে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে।
কিন্তু এই বদলীকরণ প্রক্রিয়াটি অতি গতানুগতিক হওয়ায় জনমনে সন্দেহ না কমে বরং বেড়েই চলেছে। এদেশে কোন সেক্টরে কেউ রাজনৈতিক মতাদর্শের উর্দ্ধে উঠে চাকুরী করতে পারে না। সব পেশায় পেশাদারী সংগঠন রয়েছে সেগুলো কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নানা রঙে রঞ্জিত ও বিকশিত হয়ে পড়েছে। তাই কেউ কেউ মনে করছেন, এই সনাতনী বদলী প্রক্রিয়া অবৈজ্ঞানিক ও স্বজনপ্রীতিকে আরো উস্কে দিচ্ছে। কোন প্রার্থীর নির্দিষ্ট পছন্দের তালিকায় থাকা কোন অফিসার বা কর্মী তার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকে যাচ্ছেন। কারণ তিনি নিজেই নির্বাচনী নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে একজন! তিনি তার পূর্বের স্বপদে বহাল থেকে আদেশ দিয়ে বদলী করাচ্ছেন। দেশের গণমাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, ঢাকার ওসিরা ঢাকাতেই আছেন। সেখানকার ভোটাররা বলছেন, তাহলে আসলে বদলী হলো কই?
এছাড়া এভাবে সনাতনী ধারায় বদলী করণের কাজকে একধরণের নির্বাচনী ‘রি-এ্যারেঞ্জ’বা পুন:সাজানোর আয়োজন করা হচ্ছে। এতে নিজের পছন্দনীয় অফিসার বা কর্মীকে নিজের মতো করে নিজের এলাকায় ভিড়িয়ে নেয়ার ব্যাপার ঘটছে। ফলে প্রতিপক্ষের লোকজনের মধ্যে আরো ব্যাপক সন্দেহ তৈরীর অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষ করে লটারী বা এধরণের পক্ষপাতহীন কৌশল অবলম্বন না করার ফলে নির্বাচনী নিয়ন্ত্রকদের কল্যাণে নানাভাবে যাকে যার পছন্দ বা যাকে যেখানে নিয়ে প্রতিস্থাপন করলে কার্য উদ্ধার করা সহজ হবে তাকে সেখানে বদলী করে দেয়া হচ্ছে। এমনকি একজনকে একাধিক স্থানে বদলির সংবাদও বের হয়েছে। এবারের নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি করে ডামীপ্রার্থী রেখে নিজদলের মধ্যে একতরফাভাবে মনোনয়নপত্র গৃহীত হওয়ায় নির্বাচনী বদলীর বিষয়টি নিয়ে কেউ অহেতুক প্রতিবাদ করার প্রয়োজনীয়তা মনে করছে না।
বিশেষ করে স্বতন্ত্র বা ডামী প্রার্থী অথবা আসন ভাগাভাগির প্রার্থী সবাই মনে করছেন নিশ্চিত বিজয় তাদের হবেই। সেজন্য বদলীকৃতদের নিজের মতো করে ‘রি-এ্যারেঞ্জ’বা পুন:সাজানোর আয়োজন করে নেয়াটা অনৈতিক কিছু নয়। ইসি এই বদলী প্রক্রিয়ার প্রধান কর্তৃপক্ষ হলেও কার্যত: আমাদের দেশে যে কোন বদলী বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গোপনে একটি সুবিধাবাদী চক্র কাজ করে থোকে। নির্বাচনী বদলীর ক্ষেত্রে এই সুবিধাবাদী বাণিজ্য চক্র আরো বেশী ক্ষমতাধারী ও বলিষ্ঠ হয়ে মাঠে নামতে পারে। তাদের ঠেকাতে তাদের প্রতিপক্ষ আরো বেশী সজাগ ও তৎপর হয়ে পড়লে চরম বিশৃংখলা তৈরী হওয়া কঠিন কিছু নয়।
এছাড়া কোন একজন ওসি বা এসপিকে তাদের নির্বাচনী এলাকায় কেউ মনেপ্রাণে চাচ্ছেন সেখানেই থাকুক। আবার প্রতিপক্ষরা মনে করছেন তিনি সেখানে থাকলে তাদের জন্য খারাপ বার্তা বহন করতে পারে।
যেমন, ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী চাচ্ছেন যশোরের এসপিকে অন্যত্র সরানো হোক। অপরদিকে স্বতন্ত্র ও অন্যান্য প্রার্থীরা চাচ্ছেন বর্তমান এসপি সেখাএনই থাকুন। এভাবে কান কোন অফিসারের বর্তমান কর্মস্থলে বহাল থাকুক, সেটা চাওয়া না চাওয়া নিয়ে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে লটারীর মাধ্যমে নির্বাচনী অফিসারদের বদলি ও প্রতিস্থাপন একটি ভাল ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য সমাধান বয়ে আনতে পারে।
রাজধানীতে কর্মরত নির্বাচনী চাকুরেদের উপজেলায় বা এক বিভাগের চাকুরেদের অন্য বিভাগে বা জেলা উপজেলায় বদলী করা হলে বিষয়টি নিয়ে এত সংবাদ বের হতো না। ঢাকায় কর্মরত সবাইকে ঢাকার বাইরে সরানো হোক বলে দাবী উঠেছে। লটারীর মাধ্যমে সারা দেশের নির্বাচনী চাকুরেদের বদলী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হলে সেটা হতো বেশী গ্রহণযোগ্য।
বাহুবলের পেশীর সাথে অস্ত্রবল ও পদবলের পেশীধারী নির্বাচনী চাকুরেদেরকে সমন্বয় করে নির্বাচন করতে চাইলে সেখানে গত নির্বাচনের মতো কোন কোন কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি কম অথবা ভোটার দেখা নাও যেতে পারে। কারণ ভোটাররা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদান করে শান্তিমনে বাড়িতে ফিরতে চায়।
পক্ষ নেয়া ঠেকাতে এই বদলীর আয়োজন যদি ভোটারদের চোখে ধুলো দিয়ে পক্ষপাতিত্ব করে সম্পন্ন করা হয় তাহলে সেটা গণরোষকে আরো বেশী উস্কে দিতে পারে। জনগণের চোখে ধুলো দেয়া এধরণের বদলী মানুষের ভোটাধিকার রক্ষা করতে পারে না। বরং এই প্রক্রিয়া আরো অন্যায়ভাবে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করতে পারে।
এমনিতেই একতরফা নির্বাচনের আয়োজন দেশে বিদেশে আলোচনার ঝড় তুলছে। এজন্য যে গ্লানি ও অপবাদ শুরু হয়েছে তা আমলে না নিয়ে জেদ করে সামনে এগিয়ে যাওয়া আমাদের দেশের জন্য বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে-যা ইতোমধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে অনুভূত হতে শুরু করেছে। তাই যেনতেন নির্বাচনের দায় হতে কিছুটা মুক্ত হতে এবং ভোট গ্রহণ ও ফলাফলে পক্ষপাতিত্ব ঠেকিয়ে একটি সুশৃংখল ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী পরিবেশ উপহার দিতে কর্মরত নির্বাচনী চাকুরেদের লটারীতে বদলী করা হতো উত্তম কাজ।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]