ইমাম হাসান মুক্তি, লালপুর (নাটোর) প্রতিনিধি
একটা কলাকে চার টুকরা করা হয়েছে। শ্বাসকষ্ট থেকে মুক্তির আশায় এই কলা প্রতিজন এক টুকরা করে খাচ্ছেন। আর প্রতি টুকরার দাম রাখা হচ্ছে ৫০ টাকা। অর্থাৎ এ বছর প্রতিটি কলার দাম ধার্য হয়েছে ২০০ টাকা। গত বছর (২০২২ সাল) এক টুকরার দাম ৩০ টাকা অর্থাৎ প্রতি কলা ১২০ টাকা। তার আগের বছর (২০২১ সাল) এই টুকরার দাম ছিল ২০ টাকা অর্থাৎ প্রতি কলা ৮০ টাকা। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সাথে কলার দামও বাড়ানো হয়েছে।
নাটোরের লালপুরে দীর্ঘ দিন ধরে কালীপূজার দিন অমাবস্যার সন্ধ্যা থেকে পরের দিন সকাল ১০টা পর্যন্ত এই ‘কলাচিকিৎসা’ দিয়ে আসছেন কয়েকজন কবিরাজ। প্রশাসনিক ঝামেলা এড়াতে নিজ গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে লুকিয়ে এই চিকিৎসা দেওয়ার খবর পেয়ে তা বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন ইউএনও।
রোববার (১২ নভেম্বর ২০২৩) সন্ধ্যায় দেখা যায়, শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের রোগ থেকে মুক্তির আশায় এই কলা খেতে এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন জেলার কয়েক শ মানুষ ভিড় করেছেন উপজেলার অর্জুনপুর-বরমহাটি (এবি) ইউনিয়নের শালেশ্বর গ্রামের আব্দুল মতিনের বাড়িতে। কবিরাজ মিজানুর রহমানের নিজ বাড়ি কলসনগর গ্রামে প্রশাসনিক ঝামেলার শঙ্কায় পার্শ্ববর্তী এই গ্রামে চিকিৎসা দিচ্ছেন বলে জানা যায়। আব্দুল মতিন সম্পর্কে মিজানুর রহমানের দুলাভাই। পারুল বেগমের নিকট থেকে তিনি এই চিকিৎসা শিখেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বেশ কয়েক বছর আগে উপজেলার গোপালপুর গ্রামের স্বামী আবু বকরের বাড়িতে পারুল বেগম (৬০) নামে এক নারী বছরের এক দিন কলার সঙ্গে ‘গাছগাছড়া’ দিয়ে ‘কলাচিকিৎসা’ করতেন। তিনি উপজেলার এবি ইউনিয়নের কলসনগর গ্রামের সবিউল্লাহর মেয়ে। কিন্তু ‘কথিত চিকিৎসায়’ প্রশাসনিক বাধার কারণে গত চার বছর ধরে তিনি বাবার বাড়ি কলসনগরে ‘কলাচিকিৎসা’ দিচ্ছিলেন। এছাড়া উপজেলার গোপালপুর বাজার এলাকায় মাইকেল নামের এক ব্যক্তি একই ‘চিকিৎসা’ দেন বলে জানা যায়। তিনিও পারুল বেগমের শিষ্য।
কবিরাজ মিজানুর রহমান বলেন, তিনি শালেশ্বর মসজিদের ইমাম। আমাবশ্যার রাতের সাথে অনেক কিছু জড়িত আছে। গাছগাছড়ার সাথে বছরে একবার এই কলাচিকিৎসা দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী রোগীদের এই জিনকলা, হাঁসের মাংস আর হাঁসের ডিম সারা জীবনে আর খাওয়া যাবে না। উপকার পাওয়া বা না পাওয়া আল্লাহর ইচ্ছা। তবে উপকার না হলে এত দূর থেকে মানুষ কেন আসবে? অবশ্যই উপকার পাচ্ছে।
চিকিৎসা নিতে আসা চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর গ্রামের সোহেল রানার স্ত্রী জান্নাতুল বেগম বলেন, ভেতরে গাছ দিয়ে একটা জিনকলার চার ভাগের এক ভাগ খাওয়ানো হচ্ছে। গতবার কলা খেয়ে একটু রোগ থেকে আরাম পেয়েছেন। তাই আবার এসেছেন। এ বছর এক টুকরা কলার দাম ৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। গত বার ছিল ৩০ টাকা।
শ্বাস কষ্টের রোগী পাবনার ঈশ্বরদী থেকে আসা আজগর আলী, শালেশ্বর গ্রামের ইন্তাজ আলী বলেন, কবিরাজ অমাবস্যার (কালীপূজার দিন) সন্ধ্যা থেকে পরের দিন সকাল ১০টা পর্যন্ত রোগীদের এই কলাচিকিৎসা দিয়ে থাকেন। সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার জন্য তাঁর কাছে তিন বছর এই কলাচিকিৎসা নিতে হয়।
পারুল বেগমের স্বামী আবু বকর বলেন, তাঁর স্ত্রী ২০০৫ সাল থেকে এই চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। মানুষের পিড়াপিড়িতে বাধ্য হয়ে এই চিকিৎসা দেন।
এবি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা আসলাম বলেন, শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের রোগ থেকে মুক্তির আশায় বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ শালেশ্বর গ্রামে একটি বাড়িতে ভিড় করেছেন বলে জানতে পারেন। ইউএনও-র নির্দেশে তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে গিয়ে তা বন্ধ করে দিয়েছেন।
লালপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) সুরুজ্জামান শামীম বলেন, কলার সঙ্গে গাছগাছড়া খেলে শ্বাসরোগ ভাল হয় এমন তথ্য প্রমাণ চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্মত নয়। ভিত্তিহীন এ ধরণের চিকিৎসার মাধ্যমে মানুষকে প্রতাড়িত করা হচ্ছে।
লালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীমা সুলতানা বলেন, কথিত কলা চিকিৎসার খবর পেয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যের মাধ্যমে বন্ধ করা হয়েছে। এর পরেও গোপনে কোন রকম অপচেষ্টা করা হলে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, গত বছর ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় পারুল বেগমের বাড়িতে গেলে তদারকির দায়িত্বে থাকা পারুলের ছয় ভাইয়ের একজন ছবি না তোলার অনুরোধ করেন। এমকি নাম বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি বলেন, গাছসহ এক টুকরা কলার দাম ৩০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। আমরা এই টাকা এলাকার মসজিদে দান করি। আমারে (আমাদের) কোনো স্বার্থ নেই। আগামীবার থাইকি (থেকে) এমনি (নিজ থেকে) বন্ধ কইর দিব।
এর আগে ওই দিন বিকেলে কলসনগর গ্রামে ঢুকতেই দেখা যায়, সারা দিন বৃষ্টির মধ্যে রাস্তার ধারে মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও রিকশা রাস্তার দুই ধারে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে। রাস্তায় ছাতামাথায় মানুষ ভিড় করে আছে। রোগী নিয়ে যানবাহন ঢুকছে, কলা খাওয়া হলে বের হয়ে চলে যাচ্ছে। পারুল বেগমের বাবার বাড়ির সামনে দেখা যায়, ভিড় সামাল দিতে বাঁশ দিয়ে বুথ করে দেওয়া হয়েছে। এর ভেতরে দিয়েই সারি সারি মানুষ ঢুকছেন। বুথের মুখে জানালা দিয়ে টাকা নিয়ে রোগীর মুখে কলা তুলে দেওয়া হচ্ছে। রাস্তার দুই ধারে পলিথিন টাঙিয়ে বসেছে অস্থায়ী দোকান। কেউ কেউ শুধু কলাই বিক্রি করতে এসেছেন।