-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মধ্যে মনোনয়ন বিক্রি ও জমা দেয়ার ধুম পড়ে গেছে। মনোনয়ন পেলেই জিতে যাব এমন প্রত্যাশীদের মধ্যে ব্যানার, আনন্দমিছিল নিয়ে সাড়ম্বরে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ চলছে। ছোট ছোট দলগুলোর মধ্যে কে কোনদিকে গেলে লাভবান হতে পারেন তার জন্য ভাঙ্গাগড়ার খেলা নিয়ে এখনও দ্বন্দ্ব চলছে।বড় বড় বিরোধী দলগুলো এখনও ইসির উপর আস্থাসংকট নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। একদিকে নির্বাচনী হাওয়ার আনন্দধ্বণি অন্যদিকে ইসির উপর আস্থা-অনাস্থার দোলাচালে নানা শব্দ, পোড়াগাড়ির ধোঁয়া ও তার সাথে দ্রব্যমূল্যসন্ত্রাস মিলে সাধারণ জনজীবনে এক অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
সেই ধোঁয়া ও শব্দগুলো আশির দশকের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বহুল পরিচিত সেই ‘সাউন্ড এ্যফেক্ট’দিয়ে আবারো শুরু হয়ে গেল তো গেলই! তখনকার দিনে হরতালের আগের রাতে রাস্তায় পুরনো টায়ার পুড়িয়ে আগুন, ভয়ংকর শব্দে ককটেল, বোমা ফুটালে জনগণ বুঝতে পারতো আগামীকাল খবর আছে। সবাই পরদিনের জন্য সেভাবেই প্রস্তুতি নিত। বড় সাহেবগণ অতিভোরে অফিসে যেতেন, লাগাতর হরতাল হলে কেউ কেউ অফিসেই রাত কাটাতেন। সেসব হরতালের একদিন বেলা বাড়িয়ে দেরী করে হেঁটে হেঁটে অফিসে যাবার সময় একজন বড় সাহেবের প্যান্ট খুলে নিয়ে দিগম্বর করার ঘটনা জাতি আজও লজ্জার সাথে স্মরণ করে থাকে। সেই হরতাল, অবরোধ, ভয়তাল, উৎকন্ঠা, আতঙ্ক, লাগাতর ইত্যাদি শব্দগুলো বেশ ক’বছর ধরে জাতি ভুলেই বসতে গিয়েছিল।
কিন্তু গেল ২৮ অক্টোবর, ২০২৩ থেকে রাজপথে আবারো হাজির হয়েছে বিকট শব্দ, কাঁদানে গ্যাস, গুলি, লাঠিসোঁটা ইত্যাদি। গত ২৮ অক্টোবরের হাজারো সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ শোনার পর আরো বিকট শব্দ শোনার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু ব্যাপকহারে গণগ্রেপ্তার ও কারাগারে সঁপেদেয়ার মাধ্যমে শব্দদূষণের সমাপ্তির আশাকে উবে গিয়ে পোড়াপুড়ির কালো ধোঁয়ার আগমনের মাধ্যমে বায়ুদূষণকে আমন্ত্রণ জানিয়ে দিয়েছে। সাথে সঙ্গী করে এনেছে শীতের কুয়াশা, ধুলোবালির সমন্বয়ে ‘স্মগের’চাদর। ইতোমধ্যে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা সবকিছুর মধ্যে আস্থা-নস্থায় একধরণের আনন্দাতঙ্ক তৈরী করে পরিবেশ ভারী করে দিয়েছে। একসংগে এতকিছুর সমাহার নতুন করে সবার মনে চিন্তাদূষণ শুরু করে দিয়েছে।
এই চিন্তাদূষণের কারণ অন্যজায়গায়। নভেম্বর ১৬ তারিখ সন্ধ্যায় সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বেশ ঘটা করে জাতীয় নির্বাচন ২০২৪-এর তফসিল ঘোষিত হয়েছে। এই নির্বাচনি তফসিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এত নিরাপত্তা প্রস্তুতি শুধু জাতিকে নয়- সারা পৃথিবীর মানুষের নিকট আমাদের নির্বাচন নিয়ে আরো বেশী কৌতুহলের উদ্রেক সৃষ্টি করে ফেলেছে।
একটি সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে যেসময় বড় বড় বিরোধীদলগুলোর নেতারা কারাগারে, ক্ষমতাসীনদের ভাষায় বিরোধী কর্মীরা সবাই গর্তের মধ্যে লুকিয়ে ‘ইয়া নফসি’করছে তখন সেই গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করতে গিয়ে এত নিরাপত্তা বলয় দেখে মানুষ কিছুটা বিস্মিত। তফসিল ঘোষণার জন্য এই ‘ভয়তালি’কেন তৈরী করতে হলো? এটা কি শুধু সতর্কতা নাকি কোন গৃহযুদ্ধ অথবা যুদ্ধের প্রস্তুতি সেটা সেদিনের রাস্তার চেহারা দেখলে অথবা টিভিতে সুসজ্জিত পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনীর গাড়ির বহর ইত্যাদি দেখে যে কারো ভিমড়ি খাবার যোগাড়। কোনভাবেই এটাকে দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতির চিত্র বলে মনে হয়নি। এমনকি পরবর্তীতেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। এমন প্রশ্ন মানুষকে নানা ভাবনার মধ্যে ফেলে দিয়ে আতঙ্কগ্রস্থ করে তুলেছে।
একদিকে থমথমে অবস্থা, অন্যদিকে ভীতিকর পরিস্থিতি। নির্বাচন কমিশন অফিস কোন ক্যান্টনমেন্ট নয়। সেখানে নাগরিকদের প্রবেশের ক্ষেত্রে এত কড়াকড়িও নজিরবিহীন। সেখানে কর্মরত নিরাপত্তাকর্মীরা আগে কখনও কোন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় এমন নিরাপত্তা দেননি এবং মহারথী সাক্ষাৎপ্রার্থীরাও ইসিতে প্রবেশ করতে গিয়ে এমন বিব্রতকর অবস্থার সন্মুখিন হননি বলে জানিয়েছেন।
বিশ্লেষকগণ মনে করছেন, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে যদি এরুপ ভীতিকর অবস্থায় থাকতে হয় তাহলে নির্বাচনের দিন বা সময় কি করতে হতে পারে? এমন আলোচনা আগামী নির্বাচন নিয়ে জনমনে আরো বেশী ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করে তুলেছে।
একটি দেশের নির্বাচন কমিশন সবসময় স্বাধীন নীতিতে কাজ করে থাকে। তাই তফসিল ঘোষিত হবার সাথে সাথে নির্বাচনের সাথে সম্পৃক্ত কাজ ছাড়াও দেশের জনগুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর প্রতি অতি দায়িত্বশীলতার সাথে নজর রাখতে হয়। এটা করতে গিয়ে দেশের সকল জনগণের আশা আকাঙ্খার প্রতি গুরুত্ব দিতে হয়। অন্যের আদেশে আদিষ্ট হয়ে দলকানা নীতি প্রতিপালন করতে গেলে সেখানেই ঘটতে পারে বিপদ। সেই ধরণের বিপদের ঘনঘটা তফসিল ঘোষণা করার সাথে সাথে শুরু হয়ে গেছে।
তাইতো তফসিলের ঘোষণা শোনার আগেই কাউকে মিষ্টি কেনার টাকা সংগ্রহ করা নিয়ে নেতাদের সাথে দরকষাকষি করতে দেখা গেছে। তফসিলের ঘোষণা হবার পর একটি নির্দিষ্ট জনতার আনন্দ মিছিল করার ইতিহাস কি কোন দেশে এর আগে ঘটেছিল? ভোটের তারিখ শুনেই যদি এ ধরণের আনন্দ মিছিল যদি করতেই হয় তবে দেশের সব নাগরিক একসংগে করবে। কেউ আনন্দমিছিল করবে আবার কেউ ঢিল ছুঁড়বে, গাড়ি পোড়াবে এমন পরিস্থিতি দেখে কি জানান দেয়? তফসিল হতেই কিছু মানুষের মিষ্টি বিতরণ, আনন্দ মিছিল নিয়ে জনবহুল রাস্তা বন্ধ করে হর্ষধ্বনি দেয়া- এমন নজিরবিহীন ঘটনা পৃথিবীর আর কোথাও কখনও ঘটেনি বলে মনে হয়।
তফসিল হতেই রাজপথ দখল করে নির্বাচনী পক্ষ-বিপক্ষের শক্তিগুলোর মধ্যে আচরণ ও চিৎকার-ধ্বনি দেয়ার ভিন্নতা একটি অজানা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সেদিন রাস্তায় ব্যাপক জনসমাগম দেখে গোটা দেশের পথঘাট গাড়ি-ঘোড়া শূণ্য হয়ে হরতালাবস্থা তৈরী হয়ে গেছে! অফিসফেরতরা ঘরে ফেরার জন্য গণযানবাহন পাননি। সাধারণ শান্তিপ্রিয় জনগণ অজানা ভয়ে ঘরের ভেতরে অবস্থান নিয়ে কিছু চেনা টিভিতে একপেশে বক্তব্য শুনে হতাশ হয়ে পড়ছেন। বিরোধীপক্ষ গর্তের মধ্যে কাঁথার নিচে শুয়ে ভেবেছেন, তফসিল ঘোষণা হতেই ওদের আনন্দ মিছিল, হর্ষধ্বনি, মিষ্টি বিতরণ, তাহলে আবার ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করা কেন?
ভোটের তারিখ শুনেই যদি আনন্দ মিছিল যদি করতে হয় তবে অযথা ভোটের আয়োজন কেন? এত বিপুল অর্থ ব্যয় করে ভোট করতে হবে কেন? ভিয়েতনামের নেতা হুনসেন অথবা চীনের নেতা শিন পিংয়ের মতো পার্লামেন্টে একটি ছোট্ট অধিবেশন ডেকে সারাজীবন প্রধান থেকে যাবেন-এমন আইন পাশ করলেই হলো।
কথায় বলে, ‘ভোগের কিল মায়ে কিলায়, না হয় মাচা ভেঙ্গে মাথায় পড়ে।’যারা তফসিল হতেই ওদের মিষ্টি বিতরণ, আনন্দ মিছিল, হর্ষধ্বনি দেবার জন্য লোকদেরকে রাস্তায় জড়ো করেছে তাদের অনেক টাকা। ওরা নমিনেশন পাবার জন্য দৌড় শুরু করার পর খেলা জমবে বেশ। এবার খেলা হবে ওদের সাথে ওদেরই। অর্থ্যাৎ, নিজের সাথে নিজেদের দলের লোকদের। নমিনেশন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে নিজেদের মধ্যে অন্ত:কলহ কোন্দলে পরিণত হবার ব্যাপক আশঙ্কা শুরু হওয়া অবান্তর কিছু নয়। গত নির্বাচনের পর থেকে বিশেষ একটি দলের নমিনেশন পওয়াটাই ‘সাত রাজার ধন’ হাতে পাওয়া মনে করার ফলে সবাই যে কোন কিছুর বিনিময়ে একটা নির্বাচনী যুদ্ধের টেনশনমুক্ত অতিসহজ নির্বাচন করতে আগ্রহী।
তবে এ দৌড়ে কার মাচা ভেঙ্গে মাজা ভাঙ্গবে আর কার মাথায় মৌচাক ভেঙ্গে মধু গড়াবে তা বলা কঠিন। নমিনেশন বঞ্চিতরা স্বতন্ত্র দাঁড়াতে গিয়ে কলহ বাঁধাবে। হয়তো আরো দল, উপদল তৈরী করবে। মারামারি, কাটাকাটি করবে। তখন খেলাটা আরো বেশ জমে উঠবে বলে মনে হয়। এসব কারণে ঘরের ইঁদুরে বেড়া কাটতে থাকলে নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হতে পারে। তখন রাস্তায় থাকা নিরাপত্তা বাহিনীগুলো কি করবে, কে কার পক্ষ নেবে বলে মনে হয়? তখন নির্বাচন কমিশনকে আস্থায় নিয়ে কারা মিছিল করবে? আর অনাস্থায় কারা হরতাল ডাকবে, মারামারি, কাটাকাটি করবে? এছাড়া নির্বাচনী অদৃশ্য ভূতপ্রেত ঠেকাবে কোন ওঝা?
তখন তাদের সমন্বয়হীনতার কারণে যদি ব্যাপক বিশৃংখলা সৃষ্টি হয় তাহলে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে যাবে কে বা কারা? এসব ভেবে ভেবে কূল-কিনারা করতে না পেরে চিন্তাদূষণ হচ্ছে সাধারণ নিরীহ ভোটারদের। কারণ, জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা সবকিছুর মধ্যে আস্থা-নস্থায় আনন্দডঙ্কা বাজিয়ে একধরণের আতঙ্কের আবহ তৈরী করে পরিবেশ ঘোলাটে করে ফেলেছে। যা ইতোমধ্যে অজানা বৈরী বাতাস সৃষ্টির জন্য গুমোট ভাব ধারণ করে আছে। আরো সময় না গড়ালে এর হিসেব মেলানো খুব কঠিন।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]